উদ্বোধনী ১৯৮৪, পরিচালকের বক্তব্য, আমিনুল ইসলাম

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, মাননীয় উপাচার্য, সম্মানিত সহকর্মীবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ :

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনাদের সানুগ্রহ উপস্থিতিতে আমরা বিশেষভাবে আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত বোধ করছি। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম প্রণয়ন ও পরিচালনায় আপনাদের এ উপস্থিতি ও সুচিন্তিত পরামর্শ থেকে আমরা সঠিক দিকদর্শন পাব বলে আশা করি।

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রের নাম থেকে এর উদ্দেশ্য অনুমান করা গেলেও এর কার্যক্রম ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে স্বভাবতই কিছু কৌতুহল থেকে যেতে পারে। আর এজন্যই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি, এর প্রস্তাবিত কার্যক্রম এবং সেই সংগে মানববিদ্যার ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা প্রসংগে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি।

এ কথা হয়তো বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানু-সন্ধানের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিক্ষাদান বা জ্ঞান বিতরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু অন্যতম হলেও শুধু শিক্ষাদানই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়, সনিষ্ঠ অনুসন্ধান অনুসন্ধান ও সুগভীর গবেষণার মাধ্যমে নতুন তথ্য ও তত্ত¡ আবিষ্কারও যে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত, তা-ও অনস্বীকার্য। এজন্যই পূর্ণাঙ্গ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বোঝায় এমন একটি বিদ্যাপীঠকে যেখানে যুগপৎ চলতে থাকে জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের, অর্থাৎ গবেষণা ও শিক্ষাদানের যুগ্ম কর্মধারা। আর পরিপূর্ণ শিক্ষক বলতেও নির্দেশ করা হয় এমন একজন সন্ধানী ব্যক্তিকে যিনি একাধারে জ্ঞানের গবেষক ও পরিবেশক।

পাশ্চাত্যের কথাই বলি আর প্রাচ্যের কথাই বলি, সর্বত্রই শিক্ষা ও গবেষণা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লিখিত দ্বৈত ভূমিকার দৃষ্টা ন্ত বহন করে; এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়েই জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণা পরিচালনায় বিশেষ প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এক বিষয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়, তার এর বিভিন্ন বিভাগে ও অনুষদে বেশ কয়েকটি গবেষণা কেন্দ্র ও ইনষ্টিটিউটের উপস্থিতি থেকেই অনুমেয়।

কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদটি ছিল একটি সুস্পষ্ট ব্যতিক্রম। এ অনুষদের শিক্ষকদের গবেষণা কর্মকে উৎসাহিত করার বিশেষ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা তাঁদের গবেষণাকর্ম পরিচালনা ও প্রকাশের ব্যাপারে আশানুরূপ প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা পাননি। কিন্তু এ সত্তে¡ও এখানে যেসব উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে বোধ করি ব্যক্তিগত উদ্যমই ছিল বেশী কার্যকর। সুখের বিষয়, বিলম্বে হলেও এই অবহেলিত অঞ্চলে আজ নতুন আশার বার্তা নিয়ে আবির্ভুত হয়েছে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র। তবে কলা অনুষদের প্রয়োজন বিশেষভাবে সামনে রেখে যদিও বা এর প্রারম্ভিক পদক্ষেপ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যক্রমের ব্যাপ্তিও উত্তরোত্তর স¤প্রসারিত হবে, এবং কার্যক্রমে মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ্রহী সব গবেষক এ প্রতিষ্ঠানের সমর্থন ও সহায়তা লাভ করবে এটি আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা। মোট কথা, মানববিদ্যার আগ্রহীদের জন্য গবেষণার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি ও স্প্রসারণ, গবেষণালব্দ সন্দর্ভ, গ্রন্থ ও মনোগ্রাফ প্রকাশ, গবেষণা-বৃত্তির ব্যবস্থা, গবেষণা-পদ্ধতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আন্তঃবিভাগীয় গবেষণায় উৎসাহ প্রদান, দেশবিদেশের বিশিষ্ট প্রতিব্যক্তিদের সমবায়ে সেমিনার ও বক্তৃতামালার আয়োজন উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের মুল লক্ষ্য।

কিন্তু এতো গেল বিশুদ্ধ চিন্তা ও তাত্তি¡ক পরিকল্পনার কথা। এর পরেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের প্রত্যেক্ষ পদক্ষেপের কথা। উল্লিখিত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে, এবং এই শিশু প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্ণাঙ্গ ও অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজন আর্থিক সংগতি ও সাংগঠনিক তৎপরতা, অন্যদিকে তেমনি অপরিহার্য সব মহলের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা। কিন্তু এ-ছাড়াও আরো যে জিনিসটি আবশ্যক বলে মনে করি, তা হলো মানববিদ্যার উপযোগিতা সম্পর্কে সব মহলের বিভ্রান্তির অবসান, এবং এ বিষয়ে গবেষণার গু রুত্বের যথার্থ উপলব্ধি ও স্বীকৃতি। আমি একথা বলছি বিশেষত এজন্য যে চিন্তার ক্ষেত্রে আজ যে সামগ্রিক পরিবেশ বিরাজমান, তা প্রযুক্তি, পুষ্টি, অর্থনীতি ও বাণিজ্যনীতির মতো প্রয়োগিক ও বৈষয়িক গবেষণার পক্ষে যতটুকু অনুকুল নৈতিক, নান্দনিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য মানবিক বিষয় চর্চার পক্ষে ততটুকু অনুকুল নয়, বরং কিছুটা বৈরীভাবাপন্ন। তাইতো যান্ত্রিক ও বৈষয়িক বিষয়াদির বেলায় যেখানে স্বদেশী ও বিদেশী বিদ্যানুরাগী সংস্থার আনুকুল্যে লোভনীয় প্রজেক্ট, বৃত্তি ও ফেলোশিপের হিড়িক লক্ষ্য করা যায়, এবং এসব প্রজেক্ট বিতরণ ও গ্রহণের যেখানে অপরিসীম উদারতা ও অভিলাষ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেখানে ‘হিউম্যানিটিজ’ বা মানববিদ্যার অন্তর্গত বিষয়াদি যে গুরুত্বের সংগে বিবেচনার সুযোগ পাবে না তা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়। ভাবখানা এমন, যেন মানুষ ও তার ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন এক কথায় মানববিদ্যা, কোনো সিরিয়াস চিন্তা-ভাবনার বিষয়ই নয়, এবং এ বিষয়ে গু রুত্বপূর্ণ গবেষণার কোনো প্রয়োজন কিংবা অবকাশ নেই।

সমকালীন বৈজ্ঞানিক পরিবেশে মানবিক বিষয়ের প্রতি এই অবহেলা আর যাই হোক মানবতার পক্ষে যে কল্যাণকর নয়, এবং তাতে যে মানুষ যথার্থ মানবীয় উৎকর্ষের দিকে না এগিয়ে সর্বাত্মক ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যেতে পারে এটিই আশঙ্কার ব্যাপার। কারণ, একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবিত সাফল্য ও অগ্রগতি মানুষের জন্য বিপুল বৈষয়িক সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারলেও, মানুষের দীর্ঘস্থায়ী সুখ কিংবা ব্যাপক কল্যাণের নিশ্চিতি দিতে পারে না। আর তা পারে না বলেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করার কৃতিত্ব নিয়েও সমকালীন মানুষ (বিশেষত বিত্তবান দেশসমূহের মানুষ) তার আপন জীবনের স্বরূপ ও লক্ষ্য, এবং মানুষ হিসেবে তার করণীয় সম্পর্কে অতীতের চেয়ে অনেক বেশী অনিশ্চিত, অনেক বেশী দ্বিধাগ্রস্তহয়ে পড়েছে। অনাবিল আস্থা ও শুভবুদ্ধি হারিয়ে সুসভ্য মানুষ আজ লিপ্ত হয়ে পড়েছে স্বার্থের কুৎসিৎ লড়াই ও ভ্রান্ত আদর্শের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এই অবস্থাদৃষ্টে জনৈক চিন্তাবিদ হয়তো যথার্থই বলেছেন মানুষ আজ পাখির মতো আকাশে উড়তে, মাছের মতো পানিতে সাঁতার কাটতে শিখেছে, কিন্তু শিখেনি তার নিজ আবাস মাটির পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে।

একেই বলে ‘হিউম্যান প্রেডিক্যামেন্ট’ বা মানবসঙ্কট। জাতি হিসেবে আমরা নিজেরাও এই বিশ্বব্যাপী সঙ্কট থেকে মুক্ত নই। আমাদের অবস্থা বরং আরো বেশী আশঙ্কাজনক। আমরা আছি অর্থনৈতিক ও নৈতিক এ দ্বৈত সঙ্কটে। ক্ষুদা-দারিদ্র্য ও শোষণ-বঞ্চনার দিক দিয়ে আমরা পৃথিবীর সব অসহায় জাতির মধ্যে শীর্ষস্থানের অধিকারী, এবং সে কারণেই বিত্তবান পৃথিবীর করুণার পাত্র। কিন্তু ন্যায় সত্য, সুনীত প্রভৃতি মানবীয় গুণ বা মূল্যবোধের অনুশীলনে যে আমাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল, তা-ও হলফ করে বলার উপায় নাই। কারণ অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও আজকাল সর্বক্ষণ ও সর্বত্র শোনা যাচ্ছে সনাতন মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নতুন মূল্যবোধের শূন্যতার কথা। এখানেও আমরা প্রত্যক্ষ করছি দূর্নীতির ব্যাপক প্রাদুর্ভাব, প্রবীণদের হতাশা ও তরুণদের লক্ষ্যহীনতার নিঃসন্দেহে মারাত্মক। বলাবাহুল্য, এ সঙ্কট যেকোনো বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক সঙ্কটের চেয়ে বেশী আশঙ্কাজনক। কারণ, কোনো জাতির অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়লে তাকে সহজেই পুনর্গঠিত করা যায়, কিন্তু নীতিবোধ ও মূল্যবোধের অবহেলা ও অবমাননাপ্রসূত মানবীয় সঙ্কট থেকে উত্তরণ লাভ তেমন সহজসাধ্য নয়।

আমার এসব কথা বলার লক্ষ্য শুধু একটিই। সেটি হলো এই যে, বর্তমান মানবসঙ্কট থেকে পরিত্রাণ লাভ, তথা মানবতার জন্য যথার্থ নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়ী সুখ নিশ্চিত করতে হলে শুধু প্রযুক্তি ও বস্তুবিজ্ঞানে গবেষণা করলেই চলবে না, একই সঙ্গে ব্রতী হতে হবে মানুষের স্বরূপ সন্ধানে, তার সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও নান্দনিক সত্তার গবেষণায়। আপন প্রয়োজনেই মানুষকে আজ গভীরভাবে ভাবতে হবে তার নিজেকে নিয়ে, অন্ন-বস্ত্র-ভিটামিন অনুসন্ধানের সাথে সাথে তাকে অনুসন্ধান করতে হবে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও সুনীতির স্বরূপ। কারণ এসব মূল্যেবোধের চর্চা ও অনুশীলন ব্যতিরেকে নিছক বিষয়-সম্পদ মানুষকে যথার্থ মানবোচিত জীবনের সন্ধান ও মর্যাদা দেয়া না, দিতে পারেও না।

এসব কথা বিবেচনা করেই আমরা অনুভব করেছিলাম মানুষ ও তার মৌল সমস্যাবলী নিয়ে সুগভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজন ও এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। আশা ও আনন্দের কথা এই যে, আজ এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই পরম ঈপ্সিত প্রতিাষ্ঠানটিরই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। এ যাত্রা যেন শুভ ও ফলপ্রসূ হয়, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র তার উদ্দিষ্ট কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মানবীয় সদগুণের পুষ্টি ও বিকাশে যেন ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় এই আমাদের আ ন্তরিক প্রত্যাশা। কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ অন্য যাঁরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, এবং আপনারা যাঁরা কষ্ট স্বীকার করে এখানে উপস্থিত হয়েছে, তাঁদের সকলকে আ ন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সম্মানীয় উপাচার্য,
উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও উপস্থিত সুধীবৃন্দু

আজকের এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে কর্মধারার সূচনা হতে যাচ্ছে তার আবশ্যকতার বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রতিষ্ঠানের নামেই আছে এর প্রয়োজনীয়তার ঘোষণা। মানববিদ্যা হচ্ছে সকল বিদ্যার কেন্দ্র ভূমি। মানুষ অন্য কিছু এবং অনেক কিছু হতে পারে, হওয়া স্বাভাবিক এবং হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু সবার আগে যে মানুষকে মানুষ হতে হবে এই কথাটাই মানববিদ্যা চর্চার মূল কথা আসলে। আজকের দিনে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিরাট দেহ ও হ্রস্ব বিবেকের সেই সমস্যা সমাধানের জন্য মানববিদ্যাচর্চা যত বেশী হয় ততই মঙ্গল।

আমরা আশা করবো যে, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উচ্চতা নির্ণীত হবে গবেষণার উৎকর্ষ দিয়ে, তার বিচ্ছিন্নতা দিয়ে নয়। বস্তুত এই কেন্দ্রে আমাদের চেষ্টাই হওয়া উচিত গবেষণায় যাতে বিচ্ছিন্নতা না দেখা দেয় সে-দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান ব্যক্তির সংগে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা সত্য, আরো বেশী সত্য ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা সমাজ থেকে। যদি গবেষণার কথা ধরি তাহলে দেখবো গবেষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন পরস্পর থেকে; এবং বিষয়ী আলাদা হয়ে যাচ্ছেন বিষয় হতে, গবেষকের সংগে দুরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে গবেষণার উপকরণ ও উপাদানের। এই কেন্দ্রে আমাদের কাজ হবে গবেষকদেরকে কাছাকাছি আনা। গবেষণা যে হচ্ছে না তাতো নয়। বিভাগে বিভাগে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে আলাদা করে, হয়তোবা পরস্পরের অজ্ঞাতেই গবেষণার ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। আমাদের কর্তব্য হবে গবেষকদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসা, তাঁদের মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধি করা, গবেষণার ক্ষেত্রে অন্তঃবিভাগীয় যোগাযোগ ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে করে পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিত আরো স্পষ্ট হয়, তুলনামূলক বিচার আরো সুস্থ হয়ে আসে, পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জ্ঞানের আহরণ আরো সহজ হয়ে ওঠে। আমরা চাইবো গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করতে এবং সেই সংগে লভ্য সুযোগ ও উপকরণসমূহের সংগে গবেষকদের নৈকট্য গড়ে তুলতে। এই কেন্দ্রে বিদ্ব্যোৎসাহীরা পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবেন এবং সমাজে বিদ্যার যে নতুন অবমূল্যায়ন পুরাতন কুসংস্কারের সংগে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে যৌথভাবে দাঁড়াবেন।

কিন্তু মূল বিচ্ছিন্নতা রয়ে গেছে অন্যত্র। এবং সেই বিচ্ছিন্নতাকে আক্রমণ করা উচিত সর্বাগ্রেও সর্বযতে। এই বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে সমাজের সংগে বিদ্যার। দৃশ্য-অদৃশ্য বহু দেয়াল আছে তোলা, পরিখা আছে খনন করা। বিদ্যা যত উচ্চ হয় সমাজ থেকে তার দূরত্ব তত বাড়ে এটাই মনে হয় বিদ্যমান নিয়ম, এ নিয়মেই মনে হয় কাজ চলছে। উচ্চতর গবেষণার কৌলীন্য তাই গড়ে উঠতে চায় তার আপাত বিশুদ্ধতায়, সমাজের কোলাহল ও জীবনের সংগ্রাম থেকে তার বিজ্ঞাপিত দূরত্বে। একজন গবেষকের মধ্যে আমরা নিশ্চয়ই চাইবো তন্ময় তথ্যনিষ্ঠা। চাইবো অনুত্তেজিত আহরণ ও সুশৃংখল সংগঠন। কেবল সংগ্রহ নয় পিপীলিকার মতো, সংগ্রহের সংগে সংগঠন ও মৌমাছির মতো। অহর্নিশ ব্যস্তথাকবেন তিনি এই কাজে। কিন্তু তবু জিজ্ঞাসাতো থাকে যে, বিদ্যার চুড়ান্ত পরীক্ষাটা কোথায়? বিদ্যার চুড়ান্ত পরীক্ষা মানুষের জীবনে তার অবদানে। যে-গবেষণা ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনকে যত বেশী স্পর্শ করবে, স্পর্শ করে সজীব ও সমৃদ্ধ করবে সেই গবেষণা তত মূল্যবান তত সম্মানীয়।

জ্ঞানই শক্তি-এই কথাটা যেকোনো গবেষণা কেন্দ্রের মূল ধ্বনি। কিন্তু কোন জ্ঞান? আপন অক্ষদের ঘূর্ণিয়মান জ্ঞান নয়। উর্ণনাভের তন্তু বয়ন নয়। অবরোহন নয় নির্বিচারে। সেই জ্ঞানই মূল্যবান মানুষকে যা ঐশ্বর্যশালী, প্রাণবন্ত ও সৃষ্টিশীল করে তোলে। এ কোনো নতুন কথা নয়, তবু এই উদ্বোধনী দিনে একথা নতুন করে স্মরণ করা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারায় একে সর্বদা উজ্জীবিত রাখা আবশ্যক হবে।

আমরা আশা করবো যে, এই কেন্দ্রে আমাদের আগামী দিনগুলো কর্মে মুখরিত হবে। এখানে গবেষকরা কাজ করবেন। তাঁদেরকে পরামর্শ দেবার জন্য বিশেষজ্ঞরা আসবেন। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিরা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয়তঃ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করবেন। বিশেষ বক্তৃতা ও আলোচনা সভার ব্যবস্থা থাকবে। পি-এইচ.ডি. ও এম.ফিল. ছাত্রদের গবেষণার প্রাথমিক কাজ ও অভিসন্দর্ভ রচনার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যাবে। কেন্দ্রের গ্রন্থাগারে আবশ্যকীয় গ্রন্থ ও সাময়িকী থাকবে এবং সেই সংগে কোন গ্রন্থাগারে ও সংগ্রহশালায় গবেষণায় কোন কোন উপাদান পাওয়া যাবে তার তথ্যও সহজলভ্য করা হবে। আমরা প্রকাশনারও ব্যবস্থা করবো অবশ্যই

এই সব কাজের মধ্য দিয়ে আমরা জ্ঞান আহরণ করবো। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান যে কেবল বিতরণই করে না আহরণও করে; আহরণ না করলে বিতরণ করবে কি করে? কিন্তু তাই বলে বিতরণের মূল্যও কম নয়। বিতরণও আসলে সমান মূল্যবান, কেননা বিতরণ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়তো আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকেনা, পরিণত হয় গুদামঘরে কিম্বা গুপ্ত গুহায়। বিতরণে জ্ঞান কখনো নিঃশেষ হয়না, বরঞ্চ বৃদ্ধি পায়, জীবন্ত হয়, সমসামরিক হয়। উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে বিদ্যা আমরা অর্জন করবো সোৎসাহে, কিন্তু তাকে আটক না করে ছড়িয়ে দেব যত দ্রæত পারি। প্রয়োগের নব নব দিগ ন্ত খুঁজে নিতে হবে; উর্বর করা চাই নব নব ক্ষেত্রকে।

আমাদের বিদ্যা মানববিদ্যা। এই বিদ্যাই প্রাথমিক বিদ্যা, যদিও আদিম বিদ্যা নয়, প্রতিনিয়তই সে গভীর হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। এই কেন্দ্রে আমাদের কাজের ব্যাপকতা গভীরতার বিকল্প হবে না, হবে পরিপূরক। বিশ্ববিদ্যালয সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সে আবার স্থানেরও কালেরও। সারা বিশ্বের সংগে যোগাযোগ অত্যন্তকাম্য হবে আমাদের, কিন্তু তারা প্রয়োজনে কিম্বা প্ররোচনায় কখনোই উকেন্দ্রিক হবো না আমরা, বরঞ্চ সুপ্রোথিত হবো।

আমরা জানি ইউরোপে একদা রেনেসান্স এসেছিল; মধ্যযুগের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে সেই রেনেসান্স মানুষকে নিয়ে এলো জগতের ও মূল্যবোধের কেন্দ্রভূমিতে। মানুষই মানদন্ড হয়ে উঠলো সমস্তকিছুর। এবং মানুষের নিজের মাপ নির্ণয় শু রু হলো অন্য কিছু দিয়ে নয়, অন্তর্গত মনুষ্যত্ব দিয়ে। মূল বিচার মানুষ কি হয়ে উঠলো তা দিয়েই। মানববিদ্যা কেন্দ্রের আগ্রহ থাকবে ওই মানুষ হয়ে ওঠায়, পূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনায়। সেই মানুষই পূর্ণ মানুষ যিনি বহু বিষয় জানেন ও জানতে চান এবং নিজের ভেতরে মানবিক গুণগুলোকে বিকশিত করে তোলেন; যাঁর বুদ্ধি পরিচালিত হয় হৃদয়ের শাসনে এবং শাণিত হয় জগতের সংগেদের যাঁর আত্মবিকাশ কখনোই স্বার্থপর নয়, এবং অমানবিক পরিবেশের মানবিকরণের কাজে যিনি কখনো পিছপা নন।

আমাদের সমাজ মানুষের মিত্র নয়, স্বভাব তার শত্ররই সমাজের সঙ্গে মানুষের যে নিরাপদ বিদ্যমান, সেই সামান্য পরিমাণে হলেও মানুষের পক্ষে কাজ করবার এবং কাজের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করবার জন্যই এই প্রতিষ্ঠান। আমাদের গবেষণা কখনো, কোনো অবস্থাতেই উদ্দেশ্যবিহীন হবে না। মানুষ তার চিন্তা ও উপলব্ধির সমান বড়। আমাদের লক্ষ্য হবে মানুষদেরকে আরো বড় করবার যে কর্মকান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যাহত আছে, তাতে যতটুকু সম্ভব যোগ্য দেওয়া। বলতে গেলে গবেষণা গবেষণার জন্য নয়। গবেষণা মানুষের জন্য। মূল লক্ষ্য তাই মানুষের পক্ষে কাজ করা। গবেষণার পথ ধরে ওই লক্ষ্যের অভিমুখে অগ্রসর হওয়াই আমাদের অংগীকার। জগতকে বুঝতে চাইবো, জগতকে পাল্টানোর প্রয়োজনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যকটি অনুষদের জন্যই একটি করে উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র আছে, কোথাওবা একাধিক কেন্দ্র রয়েছে, আমাদেরটি কেবল স্বতন্ত্র নয়, কনিষ্ঠও বটে। সেদিক থেকে সে বিশেষ যদের দাবীদার। সুখের খবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে আমাদের উপাচার্য এই কেন্দ্রের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। প্রাতিষ্ঠানিক অনুকুল্যের তাই অভাব হবার কথা নয়। আমরা আশা করবো কেন্দ্রের আগামী দিনগুলো হবে কর্মে মুখরিত ও সার্থকতায় সমুজ্জ্বল। আজ আমাদের এই গৃহ প্রবেশ শুভ হোক এই আমাদের কামনা। এর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে সকল বিদ্ব্যোৎসাহীর জন্য এবং তাঁদের উৎসাহই হবে এর প্রাণ। কলা অনুষদের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

শ্রদ্ধেয় সভাপতি, সম্মানীয় উপাচার্য,

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ও উপস্থিত সুধীবৃন্দু

আজকের এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে কর্মধারার সূচনা হতে যাচ্ছে তার আবশ্যকতার বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, প্রতিষ্ঠানের নামেই আছে এর প্রয়োজনীয়তার ঘোষণা। মানববিদ্যা হচ্ছে সকল বিদ্যার কেন্দ্র ভূমি। মানুষ অন্য কিছু এবং অনেক কিছু হতে পারে, হওয়া স্বাভাবিক এবং হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু সবার আগে যে মানুষকে মানুষ হতে হবে এই কথাটাই মানববিদ্যা চর্চার মূল কথা আসলে। আজকের দিনে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিরাট দেহ ও হ্রস্ব বিবেকের সেই সমস্যা সমাধানের জন্য মানববিদ্যাচর্চা যত বেশী হয় ততই মঙ্গল।

আমরা আশা করবো যে, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উচ্চতা নির্ণীত হবে গবেষণার উৎকর্ষ দিয়ে, তার বিচ্ছিন্নতা দিয়ে নয়। বস্তুত এই কেন্দ্রে আমাদের চেষ্টাই হওয়া উচিত গবেষণায় যাতে বিচ্ছিন্নতা না দেখা দেয় সে-দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটা আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান ব্যক্তির সংগে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা সত্য, আরো বেশী সত্য ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা সমাজ থেকে। যদি গবেষণার কথা ধরি তাহলে দেখবো গবেষকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন পরস্পর থেকে; এবং বিষয়ী আলাদা হয়ে যাচ্ছেন বিষয় হতে, গবেষকের সংগে দুরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে গবেষণার উপকরণ ও উপাদানের। এই কেন্দ্রে আমাদের কাজ হবে গবেষকদেরকে কাছাকাছি আনা। গবেষণা যে হচ্ছে না তাতো নয়। বিভাগে বিভাগে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে আলাদা করে, হয়তোবা পরস্পরের অজ্ঞাতেই গবেষণার ভালো ভালো কাজ হচ্ছে। আমাদের কর্তব্য হবে গবেষকদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসা, তাঁদের মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধি করা, গবেষণার ক্ষেত্রে অন্তঃবিভাগীয় যোগাযোগ ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা, যাতে করে পটভূমি ও পরিপ্রেক্ষিত আরো স্পষ্ট হয়, তুলনামূলক বিচার আরো সুস্থ হয়ে আসে, পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জ্ঞানের আহরণ আরো সহজ হয়ে ওঠে। আমরা চাইবো গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করতে এবং সেই সংগে লভ্য সুযোগ ও উপকরণসমূহের সংগে গবেষকদের নৈকট্য গড়ে তুলতে। এই কেন্দ্রে বিদ্ব্যোৎসাহীরা পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবেন এবং সমাজে বিদ্যার যে নতুন অবমূল্যায়ন পুরাতন কুসংস্কারের সংগে মিলে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে যৌথভাবে দাঁড়াবেন।

কিন্তু মূল বিচ্ছিন্নতা রয়ে গেছে অন্যত্র। এবং সেই বিচ্ছিন্নতাকে আক্রমণ করা উচিত সর্বাগ্রেও সর্বযতে। এই বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে সমাজের সংগে বিদ্যার। দৃশ্য-অদৃশ্য বহু দেয়াল আছে তোলা, পরিখা আছে খনন করা। বিদ্যা যত উচ্চ হয় সমাজ থেকে তার দূরত্ব তত বাড়ে এটাই মনে হয় বিদ্যমান নিয়ম, এ নিয়মেই মনে হয় কাজ চলছে। উচ্চতর গবেষণার কৌলীন্য তাই গড়ে উঠতে চায় তার আপাত বিশুদ্ধতায়, সমাজের কোলাহল ও জীবনের সংগ্রাম থেকে তার বিজ্ঞাপিত দূরত্বে। একজন গবেষকের মধ্যে আমরা নিশ্চয়ই চাইবো তন্ময় তথ্যনিষ্ঠা। চাইবো অনুত্তেজিত আহরণ ও সুশৃংখল সংগঠন। কেবল সংগ্রহ নয় পিপীলিকার মতো, সংগ্রহের সংগে সংগঠন ও মৌমাছির মতো। অহর্নিশ ব্যস্তথাকবেন তিনি এই কাজে। কিন্তু তবু জিজ্ঞাসাতো থাকে যে, বিদ্যার চুড়ান্ত পরীক্ষাটা কোথায়? বিদ্যার চুড়ান্ত পরীক্ষা মানুষের জীবনে তার অবদানে। যে-গবেষণা ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনকে যত বেশী স্পর্শ করবে, স্পর্শ করে সজীব ও সমৃদ্ধ করবে সেই গবেষণা তত মূল্যবান তত সম্মানীয়।

জ্ঞানই শক্তি-এই কথাটা যেকোনো গবেষণা কেন্দ্রের মূল ধ্বনি। কিন্তু কোন জ্ঞান? আপন অক্ষদের ঘূর্ণিয়মান জ্ঞান নয়। উর্ণনাভের তন্তু বয়ন নয়। অবরোহন নয় নির্বিচারে। সেই জ্ঞানই মূল্যবান মানুষকে যা ঐশ্বর্যশালী, প্রাণবন্ত ও সৃষ্টিশীল করে তোলে। এ কোনো নতুন কথা নয়, তবু এই উদ্বোধনী দিনে একথা নতুন করে স্মরণ করা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারায় একে সর্বদা উজ্জীবিত রাখা আবশ্যক হবে।

আমরা আশা করবো যে, এই কেন্দ্রে আমাদের আগামী দিনগুলো কর্মে মুখরিত হবে। এখানে গবেষকরা কাজ করবেন। তাঁদেরকে পরামর্শ দেবার জন্য বিশেষজ্ঞরা আসবেন। বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিরা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয়তঃ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করবেন। বিশেষ বক্তৃতা ও আলোচনা সভার ব্যবস্থা থাকবে। পি-এইচ.ডি. ও এম.ফিল. ছাত্রদের গবেষণার প্রাথমিক কাজ ও অভিসন্দর্ভ রচনার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যাবে। কেন্দ্রের গ্রন্থাগারে আবশ্যকীয় গ্রন্থ ও সাময়িকী থাকবে এবং সেই সংগে কোন গ্রন্থাগারে ও সংগ্রহশালায় গবেষণায় কোন কোন উপাদান পাওয়া যাবে তার তথ্যও সহজলভ্য করা হবে। আমরা প্রকাশনারও ব্যবস্থা করবো অবশ্যই

এই সব কাজের মধ্য দিয়ে আমরা জ্ঞান আহরণ করবো। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান যে কেবল বিতরণই করে না আহরণও করে; আহরণ না করলে বিতরণ করবে কি করে? কিন্তু তাই বলে বিতরণের মূল্যও কম নয়। বিতরণও আসলে সমান মূল্যবান, কেননা বিতরণ না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়তো আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকেনা, পরিণত হয় গুদামঘরে কিম্বা গুপ্ত গুহায়। বিতরণে জ্ঞান কখনো নিঃশেষ হয়না, বরঞ্চ বৃদ্ধি পায়, জীবন্ত হয়, সমসামরিক হয়। উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রে বিদ্যা আমরা অর্জন করবো সোৎসাহে, কিন্তু তাকে আটক না করে ছড়িয়ে দেব যত দ্রæত পারি। প্রয়োগের নব নব দিগ ন্ত খুঁজে নিতে হবে; উর্বর করা চাই নব নব ক্ষেত্রকে।

আমাদের বিদ্যা মানববিদ্যা। এই বিদ্যাই প্রাথমিক বিদ্যা, যদিও আদিম বিদ্যা নয়, প্রতিনিয়তই সে গভীর হচ্ছে, ব্যাপক হচ্ছে। এই কেন্দ্রে আমাদের কাজের ব্যাপকতা গভীরতার বিকল্প হবে না, হবে পরিপূরক। বিশ্ববিদ্যালয সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সে আবার স্থানেরও কালেরও। সারা বিশ্বের সংগে যোগাযোগ অত্যন্তকাম্য হবে আমাদের, কিন্তু তারা প্রয়োজনে কিম্বা প্ররোচনায় কখনোই উকেন্দ্রিক হবো না আমরা, বরঞ্চ সুপ্রোথিত হবো।

আমরা জানি ইউরোপে একদা রেনেসান্স এসেছিল; মধ্যযুগের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে সেই রেনেসান্স মানুষকে নিয়ে এলো জগতের ও মূল্যবোধের কেন্দ্রভূমিতে। মানুষই মানদন্ড হয়ে উঠলো সমস্তকিছুর। এবং মানুষের নিজের মাপ নির্ণয় শু রু হলো অন্য কিছু দিয়ে নয়, অন্তর্গত মনুষ্যত্ব দিয়ে। মূল বিচার মানুষ কি হয়ে উঠলো তা দিয়েই। মানববিদ্যা কেন্দ্রের আগ্রহ থাকবে ওই মানুষ হয়ে ওঠায়, পূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনায়। সেই মানুষই পূর্ণ মানুষ যিনি বহু বিষয় জানেন ও জানতে চান এবং নিজের ভেতরে মানবিক গুণগুলোকে বিকশিত করে তোলেন; যাঁর বুদ্ধি পরিচালিত হয় হৃদয়ের শাসনে এবং শাণিত হয় জগতের সংগেদের যাঁর আত্মবিকাশ কখনোই স্বার্থপর নয়, এবং অমানবিক পরিবেশের মানবিকরণের কাজে যিনি কখনো পিছপা নন।

আমাদের সমাজ মানুষের মিত্র নয়, স্বভাব তার শত্ররই সমাজের সঙ্গে মানুষের যে নিরাপদ বিদ্যমান, সেই সামান্য পরিমাণে হলেও মানুষের পক্ষে কাজ করবার এবং কাজের মধ্য দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করবার জন্যই এই প্রতিষ্ঠান। আমাদের গবেষণা কখনো, কোনো অবস্থাতেই উদ্দেশ্যবিহীন হবে না। মানুষ তার চিন্তা ও উপলব্ধির সমান বড়। আমাদের লক্ষ্য হবে মানুষদেরকে আরো বড় করবার যে কর্মকান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অব্যাহত আছে, তাতে যতটুকু সম্ভব যোগ্য দেওয়া। বলতে গেলে গবেষণা গবেষণার জন্য নয়। গবেষণা মানুষের জন্য। মূল লক্ষ্য তাই মানুষের পক্ষে কাজ করা। গবেষণার পথ ধরে ওই লক্ষ্যের অভিমুখে অগ্রসর হওয়াই আমাদের অংগীকার। জগতকে বুঝতে চাইবো, জগতকে পাল্টানোর প্রয়োজনে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যকটি অনুষদের জন্যই একটি করে উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র আছে, কোথাওবা একাধিক কেন্দ্র রয়েছে, আমাদেরটি কেবল স্বতন্ত্র নয়, কনিষ্ঠও বটে। সেদিক থেকে সে বিশেষ যদের দাবীদার। সুখের খবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে আমাদের উপাচার্য এই কেন্দ্রের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। প্রাতিষ্ঠানিক অনুকুল্যের তাই অভাব হবার কথা নয়। আমরা আশা করবো কেন্দ্রের আগামী দিনগুলো হবে কর্মে মুখরিত ও সার্থকতায় সমুজ্জ্বল। আজ আমাদের এই গৃহ প্রবেশ শুভ হোক এই আমাদের কামনা। এর দ্বার উন্মুক্ত থাকবে সকল বিদ্ব্যোৎসাহীর জন্য এবং তাঁদের উৎসাহই হবে এর প্রাণ। কলা অনুষদের পক্ষ থেকে আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

জনবা সভাপতি, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক,

সম্মানিত মিক্ষকমন্ডলী ও সুধীবৃন্দু :

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। এই অনুষ্ঠানে আপনাদের উপস্থিতি জ্ঞান ও গবেষণার প্রতি আপনাদের আগ্রহ ও অনুরাগের সাক্ষ্য বহন করে। আমার মনে হয় যে, জ্ঞান ও সত্যের প্রতি অনুরাগ শুধু পাত্যের সোপানই নয়, মহত্তের অন্যতম লক্ষণও বটে। আর এ ধরনের জ্ঞানের চর্চাই হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যে সমাজে জ্ঞান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের কদর নেই, সেই সমাজ নির্জীব; আর যে সমাজে জ্ঞানের যত বেশী মর্যাদা, সেই সমাজ ততই অগ্রসর ও উন্নত। এ ধরনের জ্ঞানানুরাগ আমাদের সমাজের সর্বত্র বিস্তার লাভ করুক, আমাদের অর্জিত জ্ঞান সমাজে নৈতিক প্রভাব বিস্তার ক  রুক এবং এর ফলে আমাদের দেশ ও জাতি সারা বিশ্বের চোখে উপযুক্ত মর্যাদার আসন লাভ ক  রুক, আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে তা-ই আমি আশা করি।

প্রচলিত অর্থে গবেষণা বলতে কোন গভীর ও জটিল বিষয়ে সুশৃংখল ও বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানকে বোঝায়। বিজ্ঞানসম্মত বলতে আমি অবশ্য কেবল জড়বিজ্ঞানের যান্ত্রিক পদ্ধতির কথাই বলছি না, বলতে চাচ্ছি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগীর অনুসারী সকল অনুসন্ধান-পদ্ধতির কথা। সেই দিক থেকে ইতিহাস, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি, দর্শন-এগুলো সবই বিজ্ঞান।

মানবজাতির উন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণার ভূমিকা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। উন্নতির ধারায় আজ যেসব দেশের অবস্থান সামনের সারিতে, তাদের উন্নতির মুলে রয়েছে শত-সহস্র বছরের গবেষণালব্ধ জ্ঞানশক্তি, এমন শক্তি যা অস্ত্রের শক্তির চেয়ে বহুগুণ বড়। এ অর্থে আলেকজান্ডার ও হিটলার যেমন শক্তিমান ও দিগিজয়ী, সক্রেটিস ও আইনস্টাইনও তেমনি শক্তিমান ও দিগিজয়ী। তদুপরি, সক্রেটিস ও আইনস্টাইনের মত জ্ঞানশক্তির অধিকারীরাই মানব জাতিকে যুগে যুগে উত্তীর্ণ করেছে উন্নতির ক্রমবর্ধমান সোপানে। তাই তাঁদের আসন সকলের উর্ধ্বে।

সামাজিক জাতীয় ও বৃহত্তর মানবীয় পরিমলে আমরা যদি সত্যিকারের উন্নতি অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই ব্রতী হতে হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় গবেষণাকর্মে। হিসেব করলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ গবেষণা হচ্ছে সেই তুলনায় মানববিদ্যার গবেষণার পরিমাণ কম। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আরও ব্যাপক ও গভীর গবেষণা আবশ্যক বলে মনে করি।

তবে এ ধরনের গবেষণাকে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে সীমিত রাখলে চলবে না, প্রসারিত করতে হবে বৃহত্তর সমাজে। সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে জ্ঞান চর্চা ও গবেষণার দিকে। মনে রাখতে হবে যে, সমাজ যদি জ্ঞান ও সত্যের লালন না করে, জ্ঞানবানদের শ্রদ্ধা না করে, তাহলে সেই সমাজে প্রকৃত মঙ্গল সাধিত হয়না।

আমার আজ ভাবতে ভাল লাগছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের শিক্ষকদের বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনার প্রতিশ্রতি নিয়ে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলো। উল্লেখ্য যে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছয়টি উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলো। আমি আন্তরিকভাবে আশা করবো যে, বাস্তব ও অর্থপূর্ণ গবেষণা কর্ম দ্বারা সম্মানিত শিক্ষকরা জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে এবং দেশ ও সমাজের মংগল সাধনে সক্ষম হবেন।

আমি জানি এ ধরনের একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের তত্ত¡াবধান ও উন্নয়ন বিধান এক মস্তবড় ব্যয়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আমি এখানে এ আশ্বাস দিতে পারি যে, উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র যদি তার প্রস্তাবিত মহৎ কর্মসূচী নিয়ে অগ্রসর হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে একে সবরকম সহায়তা প্রদানে আমাদের সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টার কোন অভাব থাকবে না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় একথাও বলা প্রয়োজন মনে করছি যে, এ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সাফল্যের জন্য সরকার ও অন্যান্য সংস্থার সহায়তা আবশ্যক। এ কারণেই এ প্রসংগে আমি বিশেষ করে সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, সকলের সমবেত চেষ্টার ফলে উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষনা কেন্দ্র ধাপে ধাপে উন্নতির দিকে অগ্রসর হবে এবং বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তার মহৎ ও মহান লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে পারবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিকল্পনায় ইদানীং গবেষণা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিগত এক দশকে বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এই সময়ে বহুসংখ্যক শিক্ষক উচ্চতর গবেষণা-ডিগ্রি অর্জন করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয থেকে বাংলায় ও ইংরেজীতে বেশ কয়েকটি গবেষণা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে, এবং বর্তমানে এ ধরনের পত্রিকার সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাত্র কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পঞ্চাশটির মত গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।

এসব গবেষণাকর্ম ও প্রকল্পের গুণগত মান অবশ্যই মূল্যায়ন সাপেক্ষ, এবং এ মূল্যায়নের দায়িত্ব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদেরই নয়, সমগ্র বিদ্বান সমাজের। আমি মনে করি এসব গবেষণার মূলে একটি সুস্পষ্ট নৈতিক দৃষ্টিভংগী থাকা দরকার। এ দৃষ্টিভংগী বর্তমানে আমাদের সমাজের কতটুকু আছে তা-ও যাচাই করে দেখতে হবে। কোন রকম ক্ষতিকর ধারণা যেন আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে না পারে, আমরা যেন সংস্কারমুক্ত ও স্বাধীনভাবে বিদ্যাচর্চা ও গবেষণায় মনোযোগী হতে পারি, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমার আশা ও বিশ্বাস উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র শুরু থেকেই এ বিষয়ে তৎপর হবে এবং তাতে করে আমাদের দেশে গবেষণা করার ও গবেষণা মূল্যায়নের এক মহান আদর্শ গড়ে তুলবে। আপনাদের সকলকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এখন উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

সালাহউদ্দীন আহমদ

এক

ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাঙালীর মানসভূবনে প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হয় সেটা ‘বেঙল রেনেসাঁ বা বাংরার নবজাগরণ নামে খ্যাত। এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, এই আন্দোলনের ফলেই এই উপমহাদেশে আধুনিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ, অর্থাৎ লোকায়ত মানসিকতার উন্মেষ ঘটেছিল। এই বিষয়টির ওপর গত প্রায় চার দশকে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে এই রেনেসাঁর চরিত্র ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও অনেক পিব্যক্তি, বিশেষকরে মার্কসীয় ঐতিহাসিক মূল্যবান আলোচনা করেছেন। তাঁদের মূল বক্তব্য হলো : (১) উনিশ শতকের বাংরার নবজাগরণ বা রেনেসাঁ মুষ্টিমেয় নগরবাসী, অর্থাৎ কেবলমাত্র হিন্দু সমাজের উচ্চ ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ‘ভদ্রলোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এবং দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়নি। (২) বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের কোন ভূমিকাই ছিল না, এবং এই আন্দোলনের অনুসারীরা ঔপনিবেশিক সরকারের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছিলেন; এবং (৩) মুসলমান সমাজের কোন অংশই এই আন্দোলনের সংগে জড়িত ছিল না।১ এই বক্তব্যের গু রুত্বকে অস্বীকার না করেও বলা যায়, চি ন্তা জগতের ইতিহাসে যুগে যুগে সমাজের কতিপয় মুষ্টিমেয় ব্যক্তি নব নব চিন্তার ধারক ও বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নতুন, প্রগতিশীল এবং বৈপ্লবিক এই সীমাবদ্ধতা চিন্তাধারা তাঁদের সময়কালে কখনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। এই সীমাবদ্ধতা থাকা সত্তে¡ও এইসব চিন্তানায়কের মানব সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে অবদানের কথা অস্বীকার করা যায় না।

বাংলার রেনেসাঁর যুগের নেতাদের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির সংগে সহযোগিতা প্রসংগে এই টুকু বলা যায় যে, প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলের মধ্যযুগের স্বৈরাচার ও সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে আধুনি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্মোষের সূচনা এই উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছিল, যদিও সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকার ফলে তার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়নি। কার্ল মার্কস নিজে ১৮৫৩ সালে তাঁর একটি রচনায় স্বীকার করেছেন যে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনের ভারতে জনগণ নির্মমভাবে শোষিত হয়েছে বটে, কিন্তু তবু ইংরেজ শাসন ভারতে সমাজ বিপ্লব আনতে সাহায্য করেছে। তাঁর মতে, ইংরেজরা এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে ইতিহাসের অবচেতন যন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে।২

রেনসাঁ যুগের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন মুসলমান সমাজকে একেবারে প্রভাবিত করতে পারেনি এবং রক্ষণশীল, পশ্চাদমুখী মনোভাব ও ধর্মান্ধতা গোটা মুসলমান সমাজের অগ্রগতির পথে প্রধান অ ন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলÑ এই ধারণা আমরা এতদিন পর্যন্ত পোষণ করে এসেছি। এই ধারণা যে সব তথ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে তার মধ্যে ১৮৭১ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম উইলসন হান্টারের ঞযব ওহফরধহ র্গংধষসধহং গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ সিভিলিয়ান হান্টার মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই গ্রন্থটিতে যেসব ঢালাও মন্তব্য করেছেন সেগুলো অধিকাংশ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলেও অধিকাংশ মুসলমান বুদ্ধিজীবী তাঁর মতামতকে ধ্রব সত্য বলে গ্রহণ করে এসেছেন।৩ অন্যান্য যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ঊনিশ শতকের মুসলমানদের রক্ষণশীলতা সম্বন্ধে ধারণা করা হয়, সেগুলো সবই ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় রচিত। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, উনিশ শতকের, বিশেষ করে ঐ শতকের প্রথমদিকে মুসলমান অভিজাত ও শিক্ষিত শ্রেণীর ভাষা ছিল ফারসী। এবং ফারসী যে কেবল মুসলমানরা চর্চা করতেন তা নয়। সেকালে হিন্দুরাও অতি আগ্রহের সংগে ফারসী ভাষা শিখতেন। রাজা রামমোহন রায় নিজে ফারসী ও আরবী ভাষায় সুপিত ছিলেন। ১৮০৩-১৮০৪ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশি রামমোহনের প্রথম গ্রন্থ ‘তুহফাতুল মুত্তয়াহ-হীদীন’ আরবী শিরোনাম ও ভূমিকাসহ ফারসী ভাষায় রচিত। ১৮২২ সারে তিনি ‘মীরাতুল আখবার’ নামে একটি ফারসী সংবাদ পত্র প্রকাশ করেন। খুব সম্ভব ফারসী ভাষায় এটাই প্রথম সংবাদপত্র।

১৮৩১ সালে অবস্থানকালে ইষ্ট ইিয়া কোম্পানী কার্যাবলীর ওপর ‘হাউজ অব কমন্স’ কর্তৃক নিযুক্ত একটি বিশেষ কমিটির নিকট ভারতবর্ষের তৎকালীন অবস্থা সম্বন্ধে সাক্ষ্যদান কালে রাম মোহন বলেছিলেন : “The Musalmans, as well as the more respectable classes of Hindus chiefly, cultivated Persian literature, a great number of the former and a few of the latter also extending their studies to Arabic.” মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৮৩৭ সাল পর্য ন্ত কোম্পানীর রাজত্বে ফারসী ভাষা সরকারী মর্যাদা পেয়ে এসেছিল। সুতরাং উনিশ শতকের বিশেষ করে ঐ শতকের প্রথম দিকের মুসলমান অভিজাত এবং শিক্ষিত শ্রেণীর মানসভুবনের সংগে পরিচিত হতে হলে ফারসী ভাষায় রচিত বিবিধ তথ্য সম্বন্ধে জানা একান্ত প্রয়োজন। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি সংবাদ পত্র, পুস্তক-পুস্তিকা এবং অপ্রকাশিত পাÐুলিপি। এ গুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং যতœ ও আগ্রহের অভাবে এগুলো বিনষ্ট হতে চলেছে। আনন্দের বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসী ও উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ঊনিশ শতকে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ফারসী ভাষায় রচিত কিছু গ্রন্থ ও পান্ডলিপির সন্ধান পেয়েছেন।৫ এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে ঊনিশ শতকের মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাসের মুল্যবান দলিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এগুলো বিশ্লেষণ করলে, ঊনিশ শতকের মুসলিম সমাজচি ন্তা সম্বন্ধে আমরা এতদিন যে ধারণা পোষণ করে এসেছি, সেটা পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। এমনি একটি তথ্য নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে বিষয়টির ঐতিহাসিক পটভূমি সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন।

দুই

আঠার শতকের শেষ নাগাদ ভারতীয় উপমহাদেশ এক চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিল। মোগল কেন্দ্রীয় শক্তির পতনের ফলে যে আর্থসামাজিক কাঠামো সেই রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, সেটাতে ভাঙ্গন দেখা দিল। সেই ভাঙন থেকে ভাবনার জগতও রেহাই পায়নি। এই ভাঙ্গনের মধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে যুগের অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে গতানুগতিক ধর্মীয ও সামাজিক ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধকে পুনর্মূল্যায়ন, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে প্রশ্ন করার প্রবণতা তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

মোগল আমলে সমাজের নেতৃত্ব ছিল সামরিক শক্তিপুষ্ট সামন্ত শ্রেণীর হাতে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ইউরোপীয় বণিকদের সহযোগিতা লাভ করে এদেশে এক নয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম হয়। এই শ্রেণী এবং ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট নয়া জমিদার শ্রেণীর উভয়েই সমাজের নেতৃত্বের স্থান দখল করে নেয়। এইভাবে বৃটিশ আমলের নয়া অভিজাত শ্রেণীর আবির্ভাব হয়। এই শ্রেণীর বিশেষ করে যে অংশটি ব্যবসার সংগে যুক্ত ছিল তারা একদিকে যেমন ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতি-নীতির সংগে পরিচিত হয়েছিল, অন্য দিকে তেমনি তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পাশ্চাত্যে জগতের চি ন্তার সংগে যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নয়া শাসকদের রাজধানী কলকাতায় উন্মুক্ত পরিবেশে নানা ধরনের চিন্তার সমাবেশ, সংঘাত ও সমন্বয় ঘটেছিল। বিশেষ করে সমাজ ও ধর্ম-চিন্তার ক্ষেত্রে অনুসন্ধিৎসা এবং পরমত সহিষ্ণুতা ছিল সে-যুগের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তুলনামূলক ধর্মতত্ত¡ সেকালের পÐিতসমাজে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। দাবিস্তানই মজাহিব নামক একটি গ্রন্থ, যার রচয়িতা ছিলেন সতের শতকের একজন অগ্নি-উপাসক পারসীক পন্ডিত, সে সময়ে বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন এটাকে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৭৯৭ সালে গ্রন্থটি কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। কারো কারো মতে, এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই রামমোহন রায় ধর্মতত্ত¡ বিষয়ে তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘তুহফাতুল মুওয়াহহীদীন’ রচনা করেছিলেন।

এই পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা উনিশ শতকের বাংলার সমাজ চি ন্তার স্বরূপ সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারি। সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে তিনটি প্রধান ধারাকে মোটামুটি চিহ্নিত করা যায়।৬ প্রথম ধারাটিকে রক্ষণশীল ধারা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এর ধারক ও বাহক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ঐতিহ্যিক বা গতানুগতিক ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে কোন প্রকার পরিবর্তন বা সংস্কারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের সমাজ চি ন্তায় এই রক্ষণশীল ধারা পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য রক্ষণশীল হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল বেশ কিছুটা বাস্তবমুখী। সুদীর্ঘ মুসলমান আমলে যখন রাজভাষা ছিল ফারসী, সে সময় হিন্দুরা বিনা দ্বিধায় ঐ ভাষা আয়ত্ত করে মুসলমান সরকারের অধীনে নানাবিধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে সত্য; কিন্তু তারা কখনও প্রাচীন হিন্দু ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন বোধ করেনি। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ও নানাবিধ অলঙ্ঘনীয় লোকাচার থাকা সত্তে¡ও হিন্দু ধর্মীয় ও সমাজ চি ন্তায় এমন একটি নমনীয় ও উন্মুক্ত দিক আছে, যেটা হিন্দু ধর্মকে দিয়েছে তার অন্তর্নিহিত শক্তি, যার ফলে হিন্দু ধর্ম যুগ যুগা ন্তকাল ধরে যেকোন হুমকিকে প্রতিহত করে বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি, মুসলিম আমলে হিন্দুরা বিনা দ্বিধায় মুসলিম আমলের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফারসী চর্চা করে মুসলিম শাসকদের অধীনে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভ করে নিজেদের অবস্থা সুদৃঢ় করেছিল। এ দেশে ইংরে শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নতুন শাসকদের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করতে তাদের কোন অসুবিধা হয়নি এবং বাস্তব কারণে নয়া শাসকদের ভাষা ইংরেজী শেখার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ১৮১৬ সালে কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় হিন্দু কতিপয় ইংরেজ ব্যবসায়ী ও আমলার সহযোগিতায় ইংরেজী ভাষা ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান বিষয়ে হিন্দু যুবকদের শিক্ষা দানের জন্য হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তা সত্তে¡ও হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা এতটুকু কমেনি। অন্য দিকে, মুসলিম রক্ষণশীলতার চরিত্র ছিল ভিন্ন। এর মধ্যে দুটো পরস্পর বিরোধী ধারা দেখা যায়। প্রথমটি ছিল সনাতন পন্থী ও পশ্চাদমুখী ধারা, যার অনুসারীরা তৎকালীন গোটা মুসলমান সমাজকে হজরত মুহম্মদ ও খুলাফা-ই-রাশেদীনের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখতেন। অর্থাৎ তাঁদের লক্ষ্য ছিল সাত শতকে আরব দেশে মহানবীর আমলে যেসব ইসলামী আচার অনুশীলন প্রচলিত ছিল তার ভিত্তিতে উনিশ শতকের মুসলিম সমাজকে পুনবিন্যাস করা। এই রোমান্টিক মানসিকতা যুগে যুগে মুসলিম সমাজে কিছু অংশকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে এসেছে। মুসলিম রক্ষণশীলতার আর একটি ধারা ছিল কিছুটা বাস্তববাদী এবং মধ্যপন্থী। এই ধারাকে ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকের হিন্দু রক্ষণশীলতার সংগে তুলনা করা যায়। হিন্দু সমাজের এই ধারার বাহক ছিলেন রাজা রাধাকা ন্তদেব (১৭৮৪-১৮৬৭) প্রমুখ নেতা, যাঁরা ইংরেজী ভাষায় জ্ঞান লাভ করে বিদেশী ঔপনিবেশিক সরকারের সংগে সহযোগিতা করে নানা রকমের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে দ্বিধা বোধ করেননি। কিন্তু নেহাত জাগতিক কারণে পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞানের সংগে পরিচিত হলেও তাঁরা পাশ্চাত্য সভ্যতার ছোঁয়া থেকে নিজেদের সব সময় বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা সনাতন হিন্দু ধর্মীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের যেকোন প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে এসেছেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু স¤প্রদায়ের বাস্তব প্রয়োজনের স্বার্থে রাধাকান্ত দেব যেমন হিন্দু সমাজে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের জন্য উৎসাহী ছিলেন, ঠিক তেমনি একই কারণে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৭) প্রমুখ মুসলিম নেতা মুসলমানদের ইংরেজী ভাষা শেখার জন্য উৎসাহী করেছিলেন। কিন্তু রাধাকান্ত দেব ও আবদুল লতিফ উভয়েই পাশ্চাত্য সভ্যতা ও আধুনিক উদারনৈতিক চি ন্তাধারার ঘোর বিরোধী ছিলেন। ইংরেজী ভাষা নেহাত জাগতিক কারণে অপরিহার্য বলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কিন্তু ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় আধুনিক চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ এদেশের জীবন ও জনমতকে প্রভাবিত করুক এটা তাঁরা কখনই বরদাস্তকরতে পারেননি। কিন্তু এ মনোভাব ছিল একেবারে অযৌক্তিক ও অবাস্তব। ইংরেজী ভাষা শিখে তার মাধ্যমে পাশ্চাত্য ভাবধারার সংগে পরিচিত না হওয়া কোন মতেই সম্ভবপর ছিল না। বস্তুত কালক্রমে বেশ কিছু সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান যাঁরা ইংরেজী ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন তাঁরা সমকালীন পাশ্চাত্য উদার নৈতিক মতবাদের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়ে ছিলেন। এবং এই শ্রেণীর লোকেরাই উনিশ শতকের শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এঁরাই আমাদের সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধারার প্রতিভু। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু সমাজে যেমন এই সংস্কারপন্থী ধারার বাহক ছিলেন রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩), তেমনি ঐ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমান সমাজের ঐ ধারার বাহক ছিলেন উত্তর ভারতে সৈয়দ আহমদ খাঁন (১৮১৭-১৮৯৮) ও বাংলার সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮)। রাম মোহনের আন্দোলন যেমন ছিল সমকালীন যুগের চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সনাতন হিন্দু সমাজে সংস্কার আনয়ন করে এই সমাজকে পুনর্গঠন করা; তেমনি সৈয়দ আহমদ খাঁন, সৈয়দ আমীর আলী ও মুসলিম আধুনিকতা- বাদীরা উনিশ শতকের উদারনৈতিক চি ন্তার আলোকে ইসলামের পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রের তৃতীয় ধারাটাকে যুক্তিবাদী ও আমুল সংস্কারকামী ধারা বলে চিহ্নিহত করা যায়। এর নিদর্শন ঊনিশ শতকের প্রথম দিকেই বাংলার রেনেসাঁ যুগে দেখতে পাই। এটা সর্বজন বিদিত যে হিন্দু সমাজে এই ধারার প্রধান প্রবর্তক ছিলেন কলকাতা হিন্দু কলেজের প্রখ্যাত ইউরোপীয় শিক্ষক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরেজিও (১৮০৯-১৮৩১) এবং তাঁর শিষ্যমÐলী। তাঁরা ইউরোপীয় যুক্তিবাদী দর্শনের দ্বারা এত গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ হিন্দু ধর্ম তথা যে কোন প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। রাম মোহন রায়, ডিরোজিও এবং উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁ সম্বন্ধে গত তিন-চার দশকে বিস্তর লেখা হয়েছে। সুতরাং এই মুহুর্তে এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি না।

ইসলামী ধর্মবিশ্বাসকে অনমনীয় বলে মনে হলেও মুসলিম ভাব জগতে যুক্তিবাদের কিছুটা স্থান সব সময় ছিল। খুব সম্ভব এর প্রথম নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় খৃষ্টিয় নয় শতকের আরব দেশে মুতাযিলা মতবাদের মধ্যে। মুতাযিলা দার্শনিকরা প্রাচীন গ্রীক যুক্তিবাদী দর্শন, বিশেষ করে এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ধর্ম বিশ্বাসকে কিভাবে যুক্তির সংগে সমন্বিত করা যায়- এই চিরন্তন প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু সনাতন ইসলামের গোঁড়া সমর্থকদের তীব্র বিরোধিতার মুখে চিন্তা ক্ষেত্র এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা সফর হতে পারেনি। তা সত্তে¡ও এই ধারা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, এবং মুসলিম মনোজাগতিক ঐতিহ্যে এর একটা বিশিষ্ট স্থান সব সময় রয়ে গেছে। ঊনিশ শতকের উদার নৈতিক পরিবেশে এই যুক্তিবাদী ধারাটি যেন পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল।

সাম্প্রতিক গবেষণার ফলে আমরা এমন একজন যুক্তিবাদী চিন্তানায়কের সন্ধান পেয়েছি যিনি উনিশ শতকের একজন বিস্ময়কর ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম আবদুর রহীম (অনুমান ১৭৮৫-১৮৫৩)। এই অসাধারণ পন্ডিতের এবং প্রতিভাবান পুরুষ সম্বন্ধে আমার প্রথম কৌতুহল জেগেছিল আজ থেকে ২৫ বছর পূর্বেলনে গবেষণায় নিয়োজিত থাকা কালে। ইন্ডিয়া অফিস গ্রন্থাগারে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকারী নথিপত্র দেখতে গিয়ে হঠাৎ কলকাতার গভর্নর জেনারেল দফতর থেকে ২৭শে জানুয়ারী ১৮২৬ তারিখে লেখা একটা চিঠির প্রতি হঠাৎ আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ঐ চিঠিতে এদেশে কোম্পানীর সরকারের শিক্ষানীতি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীতে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে এ বিষয়ে ইংরেজী রচনাবলীর আরবী ও ফারসী ভাষায় অনুবাদ প্রকাশ করার প্রয়োজন। এই কাজের জন্য আবদুর রহীম নামে একজন মুসলমান পন্ডিত যিনি ইংরেজী ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছেন, তাঁকে নিযুক্ত করার কথাও ঐ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ৭

এই তথ্যটি জানার পর থেকেই আবদুর রহীম সম্বন্ধে বিশদভাবে অনুসন্ধান করার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে পড়ি। কিন্তু চেষ্টা করেও এ বিষয়ে আশানুরূপ তথ্য পাইনি। আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ হবিবুল্লাহর সংগে আলাপ করতে গিয়ে জানতে পারলাম যে তিনি ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে জনৈক আবদুর রহীম রচিত ফারসী ভাষায় লিখিত একটি পান্ডলিপির খোঁজ পেয়েছিলেন। আরও জানা গেল যে এই রচনাটি আত্মজীবনীমূলক এবং এতে লেখকের যুক্তিবাদী চি ন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। আমি নিশ্চিত হলাম যে এই সেই আবদুর রহীম যার কথা একটু পূর্বে উল্লেখ করেছি। আমি অধ্যাপক হবিবুল্লাহকে জানালাম তিনি যদি এই পান্ডলিপিটি বাংলা বা ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করতেন, তাহলে উনিশ শতকের সমাজ চি ন্তার এক অজানা দিক সম্বন্ধে আমরা অবহিত হতে পারতাম। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতা ও নানাবিধ অসুবিধার জন্য তাঁর পক্ষে একাজটি করা সম্ভব হয়নি। তিনি অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে লেখা একটি প্রবন্ধে আবদুর রহীম সম্বন্ধে কিছু তথ্য সরবরাহ করেছেন যা সত্যি চমকপ্রদ। আবদুর রহীম নাকি দিল্লীতে থাকাকালীন ভারতে ওহাবী আন্দোলনের নেতা রায় বেরেলীর সৈয়দ আহমদের সহপাঠী ছিলেন। অধ্যাপক হবিবুল্লাহর ভাষায় “দিল্লীতে শিক্ষা শেষ করে তিনি (আবদুর রহীম) কলিকাতায় এসে খৃষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সী ও ইহুদী শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করেন। ইংরেজী, গ্রীক, ল্যাটিনও শিখে ছিলেন এবং পরে ইসলামে বিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে নাস্তিক বলে পরিচয় দিতে থাকেন। এই নামেই তিনি তখন থেকে পরিচিতি। ১৮২০ সালে ওহাবী আন্দোলনের নেতা বেরিলীর সৈয়দ আহমদ যখন কলিকাতায় আসেন, তখন তাঁর পুরাতন সহ পাঠিকে ইসলাম ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর সাথে দেখা করতে চেষ্টা করেন। আবদুর রহীম দেখা করেননি। এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মত পরিবর্তন করেননি।৮ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারর্সী ও উর্দু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আবদুর রহীমের রচিত পান্ডলিপিটি সংগ্রহ করে ঢাকা বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে জমা দিয়েছেন। তিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে ফারসী সাহিত্য’ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নিকট পেশকৃত গবেষণামূলক নিবন্ধ ‘পশ্চিমবঙ্গে ফারসী সাহিত্য’এই দুটি রচনায় আবদুর রহীম সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পরিবেশন করেছেন, যাতে আবদুর রহীমের ব্যতিক্রমধর্মী চি ন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।৯

যেসব সূত্র থেকে আবদুর রহীমের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন সম্পর্কে জানা যায়, এর মধ্যে তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক একটি রচনা উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় আরবী ও ফারসী ভাষা আয়ত্ত করার মধ্যে দিয়ে। সনাতন পদ্ধতি ও আচার-অনুষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করলেও, ক্রমশই তাঁর কৌতুহল বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং তিনি জ্যোতিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবিতার প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে জানা যায়। তাঁর অধিকাংশ রচনা ফারসী ভাষায় হলেও আরবীতেও তাঁর কিছু অনুবাদের কাজ রয়েছে।১০

১৮০৪ সালে আবদুর রহীম উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরে যান এবং ফারসী ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। ওখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে তাঁর মানস ভুবনে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। সেখানে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে যে বিবাদ হতো তাতে তাঁর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এক বছর থাকার পর তিনি দিল্লী চলে যানএবং সেখানে শাহ আবদুল আজিজ ও তাঁর ভ্রাতা মোল্লা রফীউদ্দিনের তত্তাবধানে ইসলামী ধর্মতত্ত বিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করেন। এ ছাড়াও দিল্লীতে অবস্থানকালে তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় রচিত বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন দার্শনিক গ্রন্থ পাঠ করেন।

প্রথমদিকে গভীর ধর্মবিশ্বাসের অধিকারী হলেও এসব গ্রন্থ পাঠের পর তাঁর মন থেকে সবরকম ধর্মবিশ্বাস অ ন্তর্হিত হয়ে যায়। পূর্বেকার ধর্মমত ও কুসংস্কারকে বিসর্জন দিয়ে তিনি মুক্ত চি ন্তার ধারক ও যুক্তিবাদী হয়ে পড়েন।১১ তাঁর মতে পরমেশ্বর বা আল্লাহ সম্বন্ধে ধারণা ইমাম বা ধর্মগু রুদের দ্বারা সৃষ্ট। তিনি বিশ্ব জগতের সার্বিক বা প্রাকৃতিক বিধানে বিশ্বাস করতেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী মত পোষণের জন্য আবদুর রহীমকে তাঁর সমসাময়িকরা ‘দাহরী’১২ নামে অভিহিত করেছিলেন। ‘দাহরী’ একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হচ্ছে সময়ের অনুবর্তী অর্থাৎ এমন একজন মুক্ত মানুষ যিনি কোন অন্ধবিশ্বাস প্রসূত সংস্কার বা ধর্মে বিশ্বাস করেন না। আবদুর রহীম মনে করতেন যে সূর্য হচ্ছে সকল সৃষ্টির উৎস।

আবদুর রহীমের প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং পন্ডিত ওয়াবদুল্লাহ-আল-ওবায়দীর (১৮৩৪-১৮৮৫) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওবায়দুল্লাহ্র স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, তিনি এই মহান শিক্ষকের নিকট থেকে দর্শন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন। মনে হয় আবদুর রহীমের মুক্ত চিন্তা ও যুক্তিবাদ ওয়াবদুল্লাহকে কিছুটা অনুপ্রাণিত করেছিল। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি তাঁর বন্ধু ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা রাজনারায়ণ বসুর (১৮২৬-১৮৯৯) অনুরোধে রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মতত্তে¡র ওপর সুবিখ্যাতগ্রন্থ ‘তুহফাতউল মুওহহীদীন’ যেটি আরবী ভূমিকাসহ ফারসী ভাষায় রচিত হয়েছিল, তার ইংরেজী অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থে রামমোহন কেবল হিন্দুদের প্রচলিত পৌত্তলিকতার বি রুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হননি, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে অলৌকিক কাহিনী ও অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কেও সংশয় পকাশ করেন। মৌলানা ওবায়দুল্লাহ-আল-ওবায়দী রামমোহনের একটি ¯প্রতিভ বক্তব্যে এইরূপ তরজমা করেন : “falsehood is common to all religions without distinction.”

ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার মুসলিম সমাজ চিন্তায় এক নয়া যুক্তিবাদী মতাদর্শের আবির্ভাব দেখা যায়। এই ধারাকে আমরা সম্পূর্ণরূপে লোকায়ত ধারা বলে চিহ্নিত করতে পারি। এই ধারার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন দেলওয়ার হোসেন আহমদ (১৮৪০-১৯১৩)। পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শিক্ষা জীবন শু রু হয় কলকাতা মাদ্রাসায়। ইংরেজী ভাষায় তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৮৬১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে বি.এ. পাস করেন। সম্ভবত তিনিই এই উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান গ্রাজুয়েট।১৫

দেলওয়ার হোসেনের চিন্তায় মৌলিকতা ও সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মুসলমান সমাজের অনুশাসন ও বিধিকে যুগের প্রয়োজনের তাগিদে আমুল পরিবর্তনের দাবী করেছিলেন। সমকালীন ইউরোপের যুক্তিবাদী দর্শন তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বিশেষ করে জন স্টুয়ার্ট মিল ও হার্বাট স্পেন্সারের রচনাগুলো মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে বৈজ্ঞানিক ও সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে মুসলমানদের অবনতির কারণসমূহ তাদের নিজেদের অতীত ইতিহাস, তাদের আইন-অনুশাসন এবং পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত রয়েছে। এ দিক দিয়ে দেলওয়ার হোসেনের চিন্তা-ধারার সংগে তাঁর সমকালীন বাংরার অপর দুই নেতা-নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলরি চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য ছিল। আমরা দেখেছি আবদুল লতিফ নেহাত বাস্তব প্রয়োজনে মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষা প্রচলনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু সমাজ চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ঘোর রক্ষণশীল। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন জৌনপুরের মৌলানা কেরামত আলরি পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি পরোক্ষভাবে মোল্লাদের গোঁড়ামী ও রক্ষণশীলতাকে সব-সময় সমর্থন করেছেন। তাঁরই জোর তদবীরের ফলে এদেশে মাদ্রাসা ব্যবস্থাকে তুরে না দিয়ে বরং স¤প্রসারণ করা হয়। আবদুর লতিফ মুসলমানদের রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামীর সংগে আপোষ করতে চেয়েছিলেন, সেগুলো দুর করার জন্য কোন চেষ্টা করেননি। তুলনামূলকভাবে সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন চিন্তার ক্ষেত্রে অনেকটা প্রগতিশীল এবং সংস্কার পন্থী। মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা তুলে দিয়ে মুসলমানদের জন্য ইংরেজী মাধ্যমে সম্পূর্ণ আধুনিক ও কারিগরী বিদ্যাশিক্ষা প্রণয়নের জন্য তিনি সুপারিশ করেছিলেন। ধর্মীয চি ন্তার ক্ষেত্রে তিনি প্রগতিশীল ও সংস্কার পন্থী ছিলেন এই অর্থে যে অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের দ্বারা ব্যাখ্যা করা ইসলামকে গ্রহণ না করে তিনি যুক্তির আলোকে, ইজতিহাদের মাধ্যমে ইসলামের মর্মবাণী গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন। আমীর আলী ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে যুক্তিবাদের আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা ও পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু সমাজের অগ্রগতির ইসলামের কোন কোন অনুশাসন ও বিধি পরিবর্তন বা বর্জন করা উচিত এ সম্বন্ধে আমীর আলী কোন কিছু পরিষ্কারভাবে বলেননি বা লেখার সাহস করেননি। বস্তুত তাঁর চি ন্তার মধ্যে বেশ কিছুটা স্ববিরোধিতা দেখতে পাওয়া যায়। তুর্কী খেলাফতের মত একটি প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করার জন্য তিনি নব্য তুরস্কের স্রষ্টা কামাল আতাতুর্কের নিকট ওকালতি করতে দ্বিধা করেন নি, যদিও এতে কোন ফল হয়নি।

অন্যদিকে, দেলওয়ার হোসেনের চিন্তাধারা ছিল স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ এবং কিছুটা বৈপ্লবিক। তিনি নিজেকে মুতাজিলা পন্থী যুক্তিবাদী দার্শনিকদের উত্তরসুরী বলে মনে করতেন। দেলওয়ার হোসেনই খুব সম্ভব প্রথম আধুষিক মুসলিম চিন্তানায়ক যিনি ইসলামের কোন কোন অনুশাসন ও বিধি বিশেষ করে যেগুলো ধর্মবিশ্বাসের সংগে প্রতক্ষভাবে জড়িত নয়, সেগুলো যুগের প্রয়োজনে পরিবর্তন এমন কি বর্জন করার কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পরিবর্তনশীল সমাজের চাহিদা স্থিতিশীল ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। বস্তুত দেলওয়ার হোসেন ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর ভাষায় : ‘There is no real connection between religion and the laws, social, civil and political under which a community lives. Religious truths transcend the powers of human understanding; while laws being pheonomenal relations are amenable to experience. দেলওয়ার হোসেনের মতে ধর্মের সংগে রাষ্ট্রের একত্রিকরণ মুসলমান সমাজের অগ্রগতিকে ব্যহত করেছে। তাঁর ধারণা মুসলমানদের মধ্যে বুদ্ধির মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতার অভাবের ফলেই তারা আধুনিক জ্ঞান ভাÐারকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়নি।

দেলওয়ার হোসেন আধুনিক লোকায়ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশ করেছিলেন। সে জন্য তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি। আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে যে ধরনের শিক্ষা দেয়া হতো সেটা তাঁর ভাষায় “Utterly unsuited to the times and it was a mere waste of means to supply people with what has no present value and will be of no future use. তিনি কলকাতা ও হুগলি মাদ্রাসা তুলে দিয়ে মুসলমানদের জন্য ইংরেজী স্কুল স্থাপনের জন্য সুপারিশ করেছিলেন।

দেলওয়ার হোসেনের সময়কালে বাংলার মুসলমান সমাজ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল মুষ্টিমেয় নগরবাসী অভিজাত শ্রেণী। এই শ্রেণীর অধিকাংশই ছিলেন উর্দুভাষী-বহিরাগত মুসলমানদের বংশধর। তাঁরা নিজেদের বাঙালী বলে স্বীকার করতেন না এবং বাঙলা ভাষার প্রতি তাঁদের ছিল অপরিসীম অশ্রদ্ধা। অন্যদিকে ছিল গ্রাম বাংলার দরিদ্র জনসাধারণ তারা ছিল বাংলা ভাষাভাষী এবং অধিকাংশই কৃষক শ্রেণীভুক্ত। অভিজাত শ্রেণীর সংগে তাদের কোন যোগাযোগ ছিল না বলে চলে। ফলে তারা অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ ও গ্রামীন নেতৃবৃন্দের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এদের মধ্যেই ছিল গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ। এই সব গ্রামীণ নেতারা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সংগে নিজেদের জড়িত করে সব সময় তাদের পাশে থেকে তাদের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করেছেন।

দেলওয়ার হোসেনের মতে বাংলা ভাষার প্রতি মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর অবজ্ঞা এবং ইংরেজী ভাষা শিখতে মুসলমান জনসাধারণের অনীহা বাংলার মুসলমানদের অনগ্রসরতার মূল কারণ। তাই তিনি বাংলার মুসলমানদের বাংলা শেখা অপরিহার্য সে কথা জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানকে দেশের জনসাধারণের সংগে পরিচিত করা যেতে পারে, কারণ তাদের সকলের পক্ষে ইংরেজী শেখা সম্ভব নয়। তিনি সুপারিশ করেন যে দর্শন, বিজ্ঞান ও মানববিদ্যা বিষয়ক ইংরেজী ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো বাংরা ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা উচিত। এবং তাঁর মতে এই অনুবাদ কর্মের দায়িত্ব নিতে হবে এদেশেরই ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তিদের।

দেলওয়ার হোসেন বহুবিবাহ এবং পর্দা প্রথা বিলুপ্ত করার আহŸান জানান। তিনি মুসলিম পারিবারিক আইনও আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী সংশোধন করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ঋণের ওপর সুদ দেয়ার বি রুদ্ধে ইসলামের বিধিনিষেধ সমর্থন করেন নি কারণ এর ফলে মুসলমান সমাজে পুঁজির বিকাশ ব্যাহত হবে বলে তিনি মনে করতেন।

দেলওয়ার হোসেনের চি ন্তাধারা সমকালীন মুসলমান সমাজে বিশেষ রেখাপাত করতে পারেনি। তৎকালীন শিক্ষিত মুসলিম স¤প্রদায় তাঁকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছে। যেহেতু তিনি কেবলমাত্র ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে তাঁর ভাবধারা প্রকাশ করতেন, দেশের অধিকাংশ জনসাধারণ তাঁর মতামতের সংগে বিশেষ পরিচিত হতে পারেনি। খুব সম্ভব এ কারণেই তিনি আজও আমাদের কাছে অবহেলিত। কিন্তু তাঁর চিন্তা ও চরিত্রের মধ্যে এমন একটা বলিষ্ঠতা ছিল, যেটা আমাদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আজকের দিনেও আমাদের মধ্যে ক’জন ব্যক্তি আছেন যাঁরা জোর গলায় বলিতে পারেন যেমন দেলওয়ার হোসেন জীবনের শেষপ্রাে ন্ত এসে বলেছিলেন : It is the duty of every man of intelligence and knowledge to seek truth, and when he finds it, it is his duty to proclaim it.”

ঊনিশ শতকের বাংলার সমাজ চিন্তাকে কোন একটি বিশেষ ধারা দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না। চিন্তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারা সমা ন্তরালভাবে প্রবাহিত হয়ে আমাদের মানসভুবন ও সাংস্কৃতিক জীবনকে সঞ্জীবিত করেছে। যুগে যুগে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে তার অস্তিত্ব ও জীবন সম্বন্ধে নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, পুরাতন সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে। উনিশ শতকটা ছিল সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের স্বর্ণযুগ এ অর্থে যে সে যুগের সমাজে সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতার উল্লেখযোগ্য পরিচয় পাওয়া যায়। এ কথা সত্য যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকায় এ সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল। সেকালের সমাজ ছিল অলঙ্ঘনীয় আচার-অনুশাসনে জর্জরিত। কিন্তু তা সত্তে¡ও চিন্তা ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ছিল সে যুগের আশ্চর্য ব্যতিক্রম। আবদুর রহীম, রামমোহন যায়, ডিরোজিও ও দেলওয়ার হোসেন-এঁরা সবাই ছিলেন সেকালের ব্যতিক্রমধমীৃ মহাপু রুষ। তবে সমকালীন সমাজে এঁরা কেউ জনপ্রিয় ছিলেন না। একটা সমাজ কতখানি উন্নত ও সভ্য সেটা নির্ধারণ করা যায় সেই সমাজে ভিন্নমত প্রকাশ করার অধিকার ও স্বাধীনতা কতখানি রয়েছে তা দিয়ে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন, চিন্তার ক্ষেত্রেও তেমনি কোন কথাই তো শেষ কথা নয়। প্রচলিত মত ও প্রথার বি রুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য আজ যাঁকে সমাজচ্যুত করা হলো, আগামী কালই হয়তো তাঁকে সমাজের শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হবেÑইতিহাসে এরকম বহু নজির দেখা যায়। এ কথারই প্রতিধ্বনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের একটি গান শুনতে পাই ঃ

“যে তোরে পাগল বলে
তারে তুই বলিস নে কিছু।
আজকে তোরে কেমন ভেবে
অঙে যে তোর ধুলো দেবে,
কাল সে প্রাতে মালা হাতে
আসবেরে তোর পিছু পিছু!”

১। Susobhan Sarkar on the Bengal Renaissance (Calcutta, Papyrus, 1979) pp. 70-71.

সুপ্রকাশ রায়, ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম (কলিকাতা, ডি এন বি এ ১৯৬৭)

বদ রুদ্দীন উমর, বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ, ঢাকা মওলা ব্রাদার্স, ১৯৭০)

২। Marx and Engels, Selected Works (Moscow, 1962), Vol. 1, p. 351.

৩। হাণ্টারের বক্তব্যের প্রতিপাদ্য ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তবাংলার মুসলমানদের অবনতির মূল কারণ। তাঁর মতে এর ফলে মুসলমান জমিদাররা তাঁদের জমিদারী হারান; সেগুলি হিন্দুদের হাতে চলে যায়। পর তাঁদের হাতে যেসব লাখরাজ স¤প্রতি ছিল সেগুলিও ইংরেজ নীতির ফলে তাঁদের হারাতে হয়। যেহেতু ভূসম্পত্তি ছিল মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর আয়ের প্রধান উৎস, এগুলি থেকে বঞ্চিত হবার ফলে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। কিন্তু এই ধারণার পেছনে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। হাণ্টার নাকি মাত্র পনের দিনের মধ্যে এই বইটি লেখা শেষ করেন। বইটিতে তথ্যবিহীন অনেক ঢালাও ম ন্তব্য করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন (A.F. Salahuddin ahmed, “Muslim thought and Leadership in Bengal in the Nineteenth Century”, B. De and others (eds.), Essays in Honour of Prof. S.C. Sarkar, Delhi, Peoples Publishing House, 1976.

৪। Written evidence of Rammohun Roy on the condition of India before Select Committee of the House of Commons on the Affairs of the East India Company, Parliamentary Papers, House of Commons, 1831, V. 320 A. 739-41.

৫। মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাংলাদেশে ফারসী সাহিত্য, (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৮৩);

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, পশ্চিম বঙে ফারসী সাহিত্য (অপ্রকাশিত), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পৃষ্ঠপোষকতার গবেষণা গ্রন্থ, ১৯৮৩।

৬। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখতে পারেন A. F. Salahuddin ahmed, social Ideas and Social change in Bengal 1818-1835 (leiden E. J. Brill 1965; 2nd ed. Raddhi, Calcutta, 1976) Ges Susobhan Sarkar, on the Bengal Renaissance, Calcutta, Papyrus 1979.

7| A. F. Salahuyddin Ahmed, Social Ideas and Social Change in Bengal 1818-1835, p. 141.

৮। আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৪, ১২৯।

৯। মুহম্মদ আবদুল্লাহ প্রাগুক্ত।

১০। আবদুর রহীম রচিত নিম্নলিখিত পুস্তকের সন্ধান ডঃ আবদুল্লাহ দিয়েছেন ঃ

(১) ফারহাঙী দাবিস্তান : ফারসী ব্যাকরণের উপর একটি বই।

(২) পান্দনামা-ই-বাহরাম : যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক ফারসী পুস্তক। এটি ১৮৬০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছিল।

(৩) তওয়ারিখে হিন্দুস্তানঃ J.C. Marshman, History of India, ফারসী তর্জমা।

(৪) কারনামা এ হায়দরী : এটি হায়দর আলি ও টিপু সুলতানের জীবনী ও কর্মকাÐের উপর রচিত ঐতিহাসিক বই। ১৮৪৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

(৫) মাশরিকুল আনওয়ার : জন গে রচিত রূপকথার উপর ইংরেজী পুস্তকের ফারসী তর্জমা।

(৬) হিকায়ত-ই-ইবরাত আয়াত : লোকমান হাকিমের গল্পের উপর ইংরেজি বই থেকে ফারসী অনুবাদ। ১৮৩০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত।

(৭)Aesop’s Fable- এর ফারসী অনুবাদ। ১৮৩০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত।

(৮) ফাতিহাতুল তারজ্জমা : Encyclopaedia Britannic থেকে অংকশাস্ত্র বীজগণিত-এর উপর প্রবন্ধাদির আরবী ভাষায় অনুবাদ।

(৯) শিদ্রাফ বায়ান ইবরাত তওয়ামান : এটি খুব সম্ভব আবদুর রহীমের সব চেয়ে মুল্যবান বই। এটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। এটিতে লেখক তাঁর চি ন্তার বিবর্তনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন কিভাবে তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান থেকে কালক্রমে একজন সংশয়বাদী নাস্তিকে পরিণত হয়ে ছিলেন। এই পুস্তকের প্রথম অংশে দার্শনিক বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশটির নাম আফসানা-ই-দেরীনে-রোজগার নামজাদ নাম এ নীগার : এটিতে লেখকের ৩৮ বৎসর পর্য ন্ত জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

১১। মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, পশ্চিম বঙ্গে ফারসী সাহিত্য, পৃ. ১২।

১২। ঐ পৃ. ১৪।

১৩। মুহাম্মদ আবদুল্লাহ, বাংলাদেশে ফারসী সাহিত্য, পৃঃ ১৪৫।

১৪। Rammouhan Roy, Tuhfatul Muwahhiddin or A gift to Deists; reprint, Calcutta, The Nineteenth Century Studies, Vol. I, No. 1, 1973, pp. 1-2 Deist- এর অর্থ হল প্রচলিত কোন ধর্মমতে বিশ্বাসী না হয়েও কেবলমাত্র যুক্তির আলোকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস।

১৫। দেলওয়ার হোসেনের জীবনী ও রচনাবলির জন্য দেখুন Sultan Jahan Salik (ed.), Muslim Modernism in Bengal: Selected Writings of Delwar Hossain Ahmed Meeraz 1840-1913 (Dhaka, Centre for Social Studies, 1980)

১৬। ঐ, পৃ: ১৩।
১৭। ঐ, পৃ: ১৫।
১৮। The Mussalman (Calcutta), 11 August, 1911, quoted in Sultan Jahan Salik, op. cit., p. ix.

মাননীয় উপাচার্য এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ,

উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা-কেন্দ্রের এই উদ্বোধনী সভায় আপনাদের উদ্দেশ্যে দু’ চারটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমার শক্তিসামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত। মানবিক গবেষণা সম্বন্ধে কোনো রকমের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিতে পারবে এ ধরনের আশা আমি পোষণ করি না। গতানুগতিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেইজন্য অতি সাধারণ পর্যায়ের কিছু কথাবার্তা বলা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় একটি অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে যে সকল আদর্শের ও মূল্যবোধের প্রয়োজন আছে, তাদেরকে বাদ দিয়ে এই কেন্দ্রের স্থিতিশীলতা ও বিকাশ সম্ভব নয়। কোনো গবেষণা-কর্মসূচীর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য যে সব পূর্ব শর্ত অত্যন্ত জরুরী, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষকদের চিন্তার স্বাধীনতা এবং অপরটি গবেষণা-কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নিরঙ্কুশ স্বাধিকার। চিন্তার স্বাধীনতা বলতে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা বুঝায়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার ঢাকার সাংস্কৃতিক জীবনের একটি গু রুত্বপূর্ণ ঘটনা। কয়েক জন মুসলমান বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। শাস্ত্রানুগত্য থেকে বুদ্ধিকে মুক্ত করাই ছিল ঐ আন্দোলনের মুল কথা। এ-দেশের কৃষিনির্ভর সাম ন্ততান্ত্রিক সমাজের মাঝখানে একটি নড়বড়ে মুসলমান মধ্য শ্রেণী তখন সবেমাত্র গড়ে উঠেছিল। তার মাথার উপর ধর্ম তখন আকাশের মতই বিস্তৃতÑতার মানসিকতায় আনুষ্ঠানিক ধর্ম ছাড়া ভিন্ন ধরনের মানবিক ও ইহজাগতিক উপকরণের উপস্থিতি ছিল নিতান্ত গৌণ। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনের ভাগ্যে যা ঘটবার কথা, তাই ঘটেছিল। মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রভাবে ঐ আন্দোলন অল্প দিনের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। উদ্যোক্তাদের মধ্যে কা রুর কা রুর মনে তথাকথিত বেঙ্গল রিনাইসাঁসের ঝলক লেগেছিল। কিন্তু আন্দোলনটিকে ধারণ ও লালন করার মত শক্তি বা সম্ভাবনা সমাজ-কাঠামোতে ছিল না। সে দিনের তুলনায় বর্তমানে আমাদের সমাজ বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে বেশী দূর এগিয়েছে বলে মনে হয় না। বিগত ছত্রিশ বছরে শিক্ষিত শ্রেণীর কাজকর্মে ও চি ন্তাচেতনায় যুক্তি-প্রবণতা ও কল্যাণপ্রসূ উদ্দেশ্য-সচেতনতা কমই লক্ষ্য করা গেছে; বরং সস্তা আবেগ ও তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বেশী করে প্রশ্রয় পেয়েছে। তাছাড়া ধর্মের নামে এক ধরনের হুজুগসর্বস্ব মানসিকতা প্রবল হয়েছে; সা¤প্রদায়িক শক্তিও সমাজে দৃঢ়ভাবে শিকড় বসিয়েছে। সীমিত রকমের গবেষণা-কর্ম ও ব্যাপক ধরনের কোনো প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন কি এই পরিবেশে বেশী দূর এগিয়ে যেতে পারে? রাজনৈতিক পরিবেশ এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। ১৯৪৭ সাল থেকে শু রু করে আজ পর্যন্ত বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসন যেমন গণতন্ত্রের বুনিয়াদকে বিধ্বস্তকরেছে, তেমনি আবার মানবিক মূল্যবোধের ও নৈতিকতার অঙ্কুরগুলোকেও উৎপাটিত করেছে। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের প্রতি অনীহা অবশ্য মুসলমান সমাজের একটি মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের প্রগতি বিরোধী মনোভাবের ঐতিহাসিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে তুর্কী সুন্নী মুসলমানদের রাজত্বকালের ঘটনা-প্রবাহে। শীয়া-ইসমাইলি রাজনীতি ও ভাবধারাকে প্রতিহত করতে গিয়ে বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সেলজুক তুর্কীদের নেতৃত্বে সুন্নী রাষ্ট্র ও সনাতন ইসলামিক তত্ত¡ ও ইসলামিক সমাজ-ব্যবস্থাকে সংরক্ষিত ও সংহত করার চুড়ান্ত প্রবণতা দেখা দিয়েছিল এগার শতকের শেষ দিকে এই প্রবণতার চরম রূপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ইমাম গাজ্জালীর ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তায়। এই প্রবণতার ফলে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ও স্বাধীন চিন্তার সুযোগ-সুবিধা আর অবশিষ্ট রইল না-গোঁড়া ধর্মতত্ত¡ই রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে প্রায় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা পেল। কঠোর রক্ষণশীল প্রবণতা সুলতান মাহমুদের রাষ্ট্রনীতির মধ্যে আগেই প্রকাশ পেয়েছিল। পরবর্তী কালের তৈমুরী সাম্রাজ্যেও এই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি রক্ষ্য করা গেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের এক বিশাল অঞ্চলে তুর্কী-তৈমুরীগণ দীর্ঘকাল রাজত্ব করেছিল। এই রাজত্বের মাধ্যমে উক্ত প্রগতি-বিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় সমগ্র মুসলিম জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ইবন্ খলদুনও এই সুন্নী জগতেরই সৃষ্টি। তাঁর লেখাতেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপযোগিতা সম্বন্ধে সচেতনতার সন্ধান মেলে না। শীয়া প-তি ও ইসমাইলি ভাবধারায় প্রভাবিত সুন্নী বিজ্ঞানীদের লেখায় অবশ্য ব্যতিক্রমধর্মী মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান কালের মুসলমানগণ বোধ হয় রক্ষণশীল মানসিকতার ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে ইতিহাস থেকেই পেয়েছে।

বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে এ-ধরনের পরিস্থিতি প্রকট রূপ পেয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কারণে। এই অঞ্চলে এক ধরনের ধর্মভিত্তিক সামন্ততন্ত্র টিকে আছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। ধনতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ এখানে কখনো হয়নি; ধনতন্ত্রের অনুষঙ্গ হিসেবে বুর্জোয়া সমাজ-সংস্কৃতিও এখানে গড়ে উঠেনি। মানবিক যুক্তিবাদী চেতনা, বিজ্ঞান বোধ এবং সামাজিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার ও সামাজিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা সেই জন্য আমাদের মূল্যবোধে ও প্রত্যয়ের জগতে প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। মুসলমানদের প্রগতিবিমুখ, ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের কথা আমরা আগেই বলেছি। এই ঐতিহ্যও কিন্তু মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রেরই অবদান।

বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব গবেষণা-কার্যের জন্য আদৌ সহায়ক নয়। হুজুগের প্রয়োজন জীবনের কোনো ক্ষেত্রে আছে কি না, জানি না। তবে ধর্মের বুনিয়াদ বিশ্বাস ছাড়া শক্ত হতে পারে না। সত্যের সন্ধানে যে গবেষক চলেছেন, তাঁর জন্য তথ্য এবং যুক্তিই সম্বল। আর এই সন্ধান-কার্যেই দেখা দেয় বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী মানসিকতার প্রয়োজন। এই কাজে হুজুগ আর বিশ্বাসের স্থান নেই। গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি নির্মোহ ও স্বচ্ছ হয়, যদি তা ধর্মীয় সংস্কার বা রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকে তবে সত্যের সন্ধান তিনি পাবেন। যে-সমাজে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানবুদ্ধি অনুপস্থিত, গবেষকের অক্লা ন্ত ও আ ন্তরিক প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের পরিপন্থী বা প্রচলিত রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীত কোনো নির্মম সত্যকে সেই সমাজ গ্রহণ করতে পারে না। ধরে নেওয়া যাক, রাস্ট্র রাসেলের মতই কোনো প্রতিভাসম্পন্ন লেখক সত্য-সন্ধানীর মনমেজাজ নিয়ে অত্য ন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে প্রচলিত সামাজিক সংস্কার, সনাতনী ধর্মবুদ্ধি ও রাষ্ট্রের ভিত্তি সম্বন্ধে কতকগুলি প্রশ্ন তুললেন- ঐ ধরনের সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাকে তিনি নিতান্ত যুক্তির ভিত্তিতে অস্বীকার করে বসলেন। এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা কি আমাদের দেশে আদৌ আশা করা যায়? এই স্বাধীনতার অন্তত আংশিক সম্ভাবনা ইংল্যাডে থাকতে পারে। সে-দেশ বিগত সোয়া দু’শ বছরে সমাজ-বিবর্তনের একটি দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসেছে। সাম ন্তবাদী কৃষিপ্রথার ধনতান্ত্রিক কৃষিপ্রথায় রূপান্তর গ্রহণ, এই রূপান্তরিত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত কৃষিলব্ধ ধনের ও লভ্যাংশের শিল্পায়নে বিনিয়োগ, তারপর শিল্প বিপ্লব এবং অবশেষে শিল্প বাণিজ্যভিত্তিক ধনতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ-ইংল্যাডের আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের প্রক্রিয়া ছিল অনেকটা এমনি ধরনের। এই সামাজিক রূপান্তরের অনুষঙ্গ হিসেবেই দেখা দিয়েছিল অবাধ অর্থনীতি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। লেখক বা গবেষকের স্বাধীনতা ঐ ধরনের সমাজেই আসতে পারে এই স্বাধীনতা কেউ জোর করে উপর থেকে লেখক সমাজের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। আমাদের দেশ সমাজ-বিবর্তনের পূর্বোক্ত স্তরগুলো পার হয়নি। এখানে গবেষক ও সৃজনশীল লেখক মধ্যযুগীয় সাম ন্ততান্ত্রিক চিন্তাচেতনায় ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার শৃঙ্খলে বাঁধা।

চিন্তার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিরাজমান কতকগুলি বাধার কথা আমরা বললাম। এগুলি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিরই সৃষ্টি করা বাধা। আরো কতকগুলি প্রতিবন্ধকতা আছে। সেগুলি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। আজকাল বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনা চলছে। এধরনের গবেষণার আপাত এ্যাকাডেমিক চারিত্র্যের আড়ালে অ ন্তত কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বহু বিদেশী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে গবেষণার জন্য আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। এ ধরনের গবেষণা প্রকল্পগুলি অনেকটা রহস্যময়। প্রকল্পগুলির মেয়াদ শেষ হলে ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার কথা। এই প্রতিবেদনগুলি যে বিদেশী শক্তিগুলির কাছেই চলে যায়, সে-কথা বোধ হয় সবার কাছেই বোধগম্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের দেশের সমস্যা বাদ দিয়ে বিদেশিগণ এদেশের সমস্যার প্রতি এতটা আগ্রহশীল কেন? বিদেশী অর্থে পরিচালিত গবেষণার জন্য সংগৃহীত তথ্য এবং সেই গবেষণার পদ্ধতি ও ফলাফল ত বস্তুনিষ্ঠ না হওয়াই স্বাভাবিক। এ-সব ক্ষেত্রে যদি কোনও একাডেমিক সমস্যার তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেওয়াও হয়, তবে কি সে কাজটি করা হয় নিছক জ্ঞান অর্জনের জন্য, না বিদেশীদের স্বার্থে ও তাদেরই মুল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে? এ-জাতীয় গবেষণার পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কতটা আশা করা যায়?

বাংলাদেশ বর্তমানে আ ন্তর্জাতিক ধনতন্ত্রের কবলে পুরোপুরি আটকা পড়ে আছে। এখন এদেশ বহুজাতিক শোষণের এক অবাধ ক্ষেত্র। বিদেশী শক্তিগুলির সহায়ক হিসেবে এদেশের সামাজিক বিন্যাসেও ধনিক ও শোষক শ্রেণীর অনেকগুলি স্তরের সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশী সাহায্যে পরিচালিত প্রজেক্টগুলির সঙ্গে কি এই আ ন্তর্জাতিক ধনতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই? এ-কথা সত্য যে কোনো গবেষকই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এই পরিস্থিতিকে পালটাতে পারবেন না। কিন্তু পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতনতা বোধ হয় গবেষকদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ যদি আমাদের বিচারবুদ্ধিকে প্রণোদিত না করে, গবেষণার ক্ষেত্রে যদি আমরা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা সম্পূর্ণ রূপে ভুলে যাই, তবে আমাদের গবেষণা-কর্ম তার মানবিক উপাদান ও সামাজিক ভিত্তিভূমি সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলবে।

যাঁরা গবেষণা করবেন বর্তমান কালের প্রতিকুল পরিবেশেই তাঁদের কাজ করতে হবে। সার্বিক গবেষণার জন্য বাইরে থেকে সরবরাহ করা কোনো গবেষণা-পদ্ধতি বা সীমিত প্রকৃতির প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত কোনো ধান-করা মডেল গ্রহণে বাধা নেই। ঐ ধরনের পদ্ধতির ও মডেলের উপযোগিতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পারলেই তবে তারা গ্রহণযোগ্য। নির্বাচিত সমস্যার জন্য পুরোপুরি উপযোগী মডেল যখন নিজেরাই তৈরি করতে পারব তখন ঐ বিদেশী মডেলকে বাদ দেওয়া অবশ্যই সম্ভব হবে। তবে দেখা গেছে যে, এ-সব ক্ষেত্রে গতানুগতিক চি ন্তা, অনুকরণপ্রিয়তা এবং বহু দিনের অভ্যাসই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। কোনো গৃহীতব্য মডেলের আংশিক পরিবর্তন এবং প্রয়োজন অনুসারে সম্পূর্ণ রূপান্তর সব সময়ই সম্ভব। ক্ষেত্র-বিশেষে গবেষণার কতকগুলির সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যাদের সমাধান সনাতনী বা সেকেলে মডেলের অনুসরণে সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ ধরনের পরিস্থিতিতে গবেষকের জন্য যে কাজটি অপরিহার্য, তা হচ্ছে একেবারে নতুন মডেলের উদ্ভাবনাÑএ ক্ষেত্রে কোনো পুরনো বা ব্যবহৃত মডেলের অনুসরণের পরিণতি হবে সম্পূর্ণ নৈরাশ্যজনক। বিদেশের পতিদের থিওরি বা মতামত গ্রহণ করা কোনো অপরাধ নয়। এই গ্রহণধর্মিতার ফলে যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থেকে বিচ্যুত হয়ে বিদেশী স্বার্থ ও বিদেশী মূল্যবোধের প্রতি গবেষক পক্ষপাতিত্ব দেখান, তবে সেই গবেষণার ভিত্তি বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না।

গবেষক সত্যের সন্ধানীর শুধু সত্যের প্রতি গবেষকের আকর্ষণ ও আনুগত্য থাকবে এবং সত্য যাচাই করার জন্য গবেষক যে মানদÐ ব্যবহার করেন তাই তাঁর প্রধান অবলম্বন এই ধরনের বহু আপ্তবাক্য শোনা যায়। সত্য কি তেজাবি সোনার মত কোনো ৎবধফুসধফব বস্তু? মানদের কথাটা এ-ক্ষেত্রে বোধ হয় তাৎপর্যপূর্ণ। সত্য কতকগুলি প্যাটার্নে বিন্যস্ত; হতে পারে সে প্যাটার্ন ভাববাদী দৃষ্টিতে এক রকম এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিতে অন্য রকম। এই সত্যের প্রসঙ্গে গবেষকের মূল্যবোধ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠে। গবেষক কি তাঁর মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরে থাকতে পারেন? তিনি বিশেষ একটি সমাজ-ব্যবস্থার অংশ। তাঁর মন গড়ে ওঠে বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে। মূল্যবোধের ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত বা নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ সেইজন্য তাঁর পক্ষে অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। বিষয় নির্বাচন, গবেষণা-পদ্ধতির প্রয়োগ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্যবিন্যাস, মৌল ধারণা বা concept- এর ব্যাখ্যা প্রদান এবং এ-জাতীয় বহু ক্রিয়াকর্মের ভিতরে গবেষকের মূল্যবোধ কাজ করে যায়। অনেকেই হয়ত বলবেন, আত্মসচেতনতা এ-ক্ষেত্রে গবেষকের জন্য বড় রক্ষাকবচ। কিন্তু অবদমিত মূল্যবোধ ত বাঁকাচোরা পথেও ক্রিয়াশীল হতে পারে। আমাদের মনে হয়, মূল্যবোধ সম্বন্ধে শুচিবাইগ্রস্তহওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই। কা রুর প্রত্যয়ের কেন্দ্রে যদি কোনো সুস্থ, বস্তুভিত্তিক মূল্যবোধ স্থান করে নিয়ে থাকে, তবে তিনি তার যথোপযুক্ত স্বীকৃতি ও মর্যাদা অবশ্যই দিতে পারেন। মূল্যবোধ সম্বন্ধে তিনি সচেতন হলে দেখা যাবে যে, তাঁর মৌল ধারণাগুলি, সমস্যার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর মতামত ঐ মূল্যবোধ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মূল্যবোধ সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে নির্লিপ্ত হতে পারলে Nationalist Angle, Imperialist Angle, Growth-Oriented Theory, মার্ক্সবাদী অভিমত, ওয়েবারীয় মতবাদ Whiggishness, Postivism এবং এ জাতীয় আরো বহু দৃষ্টিকোণ, থিওরি ও মতামত আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে ভিড় জমাত না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতিই যদি আমাদের কাম্য হয়, তবে মূল্যবোধের প্রভাবকে ও মতামতের লড়াইকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, মানববিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল কি ব্যবহারিক জীবনে আদৌ কাজে আসবে? আমাদের ধারণা, এই গবেষণা দু’ রকমভাবে কাজে লাগতে পারে। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষণাধর্মী চর্চা সামগ্রিকভাবে আমাদের মনের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। ঐ চর্চার ফলে আমাদের মনের অনুশীলন-পরিশীলন ঘটে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির গীও প্রসারিত হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, মানবিক ক্রিয়াকর্মের সামগ্রিকতাকে আমরা নিবিড়ভাবে বুঝতে পারি। সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি তার ফলে আমাদের কাছে বোধগম্য হয়। মানব সমাজের একটি বিশাল অংশ যখন ক্রমাগত dehumanized বা মানবিক গুণ বর্জিত হয়ে ধ্বংসের প্রায় মুখোমুখি হয়েছে, তখন মানুষকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার এই প্রয়াস কি একটি বড় কাজ নয়? অনেকই বলতে পারেন যে, মানববিদ্যা অনুশীলনের কল্যাণকর দিক সম্বন্ধে এটি একটি ভাববাদী ধারণা। আমাদের মনে হয়, কোনো সমাজ সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারলে তার বর্তমান সমস্যা-সঙ্কটের দূরীকরণের জন্য বস্তুগত ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সম্ভব। যদি কোনো লোকগোষ্ঠীর সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস পড়ে তাদের সমাজ-জীবনের দুর্বল ও ভেদ্য অংশগুলি খুঁজে বের করতে পারা যায়, তবে তাদের জীবনের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে বিভিন্ন রকমের সক্রিয় পন্থাও খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। তবে মানববিদ্যার প্রয়োগমূল্য নেই, এ-অভিমত তাই ভ্রান্ত বলে মনে হয়। তবে মানববিদ্যার civilizing influence কে আগ্রাহ্য করা যাবে না। বিজ্ঞানও প্রকৌশল যেমন দ্রæতভাবে আমাদের জৈবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, মানববিদ্যার প্রয়োগ তেমন তাৎক্ষণিকভাবে ফলপ্রদ হতে পারে না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকেই বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতনতা সভ্য জগতের মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পায় এবং মানববিদ্যার গু রুত্ব সেই অনুপাতে কমে যায়। জৈবিক চাহিদা ও মানসিক প্রয়োজন-এ দুয়ের মধ্যে কোনটিকে বাদ দিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। সেই জন্য জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও মানববিদ্যার মধ্যে গুরুত্বগত ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজন উন্নত দেশগুলিতে অনুভুত হচ্ছে। একাডেমিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের এই দুই শাখার মধ্যকার ব্যবধান বোধ হয় কমিয়ে আনা কোনো অসম্ভব কাজ নয়। বিজ্ঞানের বিশুদ্ধতার কথাই যদি উঠে তবে বলা যায় যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন সমস্যা অনবরত মানব-মনের স্পর্শ পাচ্ছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিও মানুষের মনের তৈরি। এসব ক্ষেত্রে এমনি করে মানববিদ্যার ছোঁয়া লাগছে। ভুগোল, ভূতত্ত¡ও অঙ্কশাস্ত্রের কতকগুলি এলকা ত মানববিদ্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সম্পর্কের এই সূত্র ধরে বিজ্ঞান ও মানববিদ্যার মধ্যকার যোগাযোগের প্রক্রিয়াও বোধ হয় শুরু করা যেতে পারে। Quatification বা পরিমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং Comparative Methodology বা তুলনামূলক পদ্ধতি মানববিদ্যার কোনো কোনো শাখার এবং সমাজতন্ত্রের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে। এদের মধ্যে একটি অঙ্কশাস্ত্র থেকে আগত এবং অন্যটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্যতম গবেষণা-পদ্ধতি। এ-ধরনের লেনদেন পূর্বোক্ত সমন্বয়ের প্রক্রিয়াকে সহজতর করেছে।

বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের প্রভাব মানববিদ্যার উপরে স্বাভাবিক ভাবেই পড়বে। বিগত চল্লিশ বছরে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটেছে আশাতীতভাবে। পরমাণবিক যুগের বিস্ময় কাটবার আগেই মহাশূন্য বিজয়ের যুগে মানুষের উত্তরণ ঘটল। মানব-সভ্যতার এই অগ্রগতির ও সাফল্যের গর্ব মানব মনকে স্পর্শ করবেই, মানুষের চিন্তাভাবনা ও আবেগকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করবে। তবে আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজ-মানস এখনো অনেকটা আদিম পর্যায়ে আছে বলে বর্তমান কালের আবিষ্কিয়া আমাদের মনে উল্লেখযোগ্য রকমের সাড়া জাগাতে পারছে না। এটা হচ্ছে আমাদের বিজ্ঞান বিমুখ মানসিকতার লক্ষণ। বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অগ্রগতির ফলে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক ও ঐতিহাসিক মূল্যবোধ ইতিপূর্বেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ঐতিহ্যভিত্তিক সমাজে ভাঙন ধরেছে; তবে তবে কোনো নতুন সমাজ-ব্যবস্থার সূচনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। সামাজিক রূপা ন্তরের প্রক্রিয়ায় প্রকৌশল যে অত্যন্ত গু রুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ কোনো কারণ নেই।

বিজ্ঞানের প্রভাব আত্মস্থ করে মানুষের মন ও মানববিদ্যা ক্রমাগত সমৃদ্ধি পাবে। এই প্রভাবের কথা মনে রেখে বিজ্ঞানের সঙ্গে মানববিদ্যার সম্পর্ক ভবিষ্যতে বারবার মূল্যায়ন ও নির্ধারণ করতে হবে। তার ফলে মানবিক জ্ঞানের চারিত্র্য ও পরিপ্রেক্ষিত মাঝে মাঝে বদলে যাবে; মানববিদ্যার অনুশীলনে গতিশীলতা দেখা দেবে। নিজস্ব পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য ও বিষয়গত স্বনির্ভরতা নিয়ে এ-বিদ্যা জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমনি করে একটি ক্রমবিকাশমান বিদ্যা হিসেবেই টিকে থাকবে। জীবনের মৌলিক চাহিদা মিটাতে গিয়ে জ্ঞান ও প্রকৌশলের উপযোগ ও প্রয়োগ যেমন বাড়বে, তেমনি মানববিদ্যার অনুশীলন নিছক জ্ঞানার্জনের সীমারেখা অতিক্রম করে জৈবিক প্রয়োজনের সঙ্গেও যুক্ত হবে। কৃষি-সংস্কার অর্থনেতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, বাজেট প্রণয়ন, সমবায় সংস্থা গঠন প্রভৃতি কাজে এ-পর্যন্ত চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় পাওয়া গেছে। এ-দেশের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস, লোকজনের আচার, সংস্কার, মানসিক অভ্যাস ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আদৌ না বুঝে অনেক সমযে বিদেশী মডেলের অন্ধ অনুকরণে ঐ ধরনের গু রুত্বপূর্ণ কাজগুলিতে হাত দেওয়া হয়েছে বলে শুধুমাত্র শ্রম, অর্থ ও সময়ের অপচয় হয়েছে। এই জন্য আমরা মনে করি যে, মানববিদ্যা এ-সব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। মানববিদ্যার এই গঠনমূলক ভূমিকা অর্থনীতি ও প্রকৌশলের ভূমিকার চেয়ে গৌণ নয়। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, অশিক্ষা ও স্বাস্থ্যহীনতার মোকাবেলায় এবং জীবনের মান উন্নয়নের প্রকৌশলের ভূমিকা যান্ত্রিক পর্যায়ের। মানববিদ্যার ভূমিকা মানুষের কর্মশক্তি, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সক্রিয়া করে তোলার ভূমিকা। মানুষের নিজের জীবনকে বুঝবার জন্য, নিজের সঙ্গে সমাজের অন্য লোকজনের সম্পর্ক বুঝবার জন্য এবং বিশাল সভ্য সমাজের মাঝখানে তার স্থান নিরূপণের জন্যে এ-ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানের সঙ্গে মানববিদ্যার সুস্থ সহাবস্থান তাই একা ন্তভাবে কাম্য।

বর্তমান গবেষণা-কেন্দ্রটি বহু গবেষকের, কর্মীর ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সামগ্রিক ও যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমেই বাঁচতে পারে-কারণ এর বাঁচার অন্য কোনো উপায় নেই। আমাদের গবেষণা-কর্ম যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায়, তবে এ-কেন্দ্র টিকবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অতি সমৃদ্ধ মানবিক সম্পদ আছে। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে সক্রিয় করে তুলতে পারলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য আসতে পারে। অথচ ১৯২১ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বা শিক্ষকদের তফর থেকে গবেষণাকে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার উদ্যোগ তেমন একটা নেওয়া হয়নি। এই ধরনের কাজের উপযোগ সম্বন্ধে কেউ চিন্তাভাবনা করছেন বলেও আমাদের জানা নেই। মানবিক সম্পদকে যৌথ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের প্রবহমানতা সৃষ্টি করা সভ্য মানুষের কাজ। কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি অ ন্তত আপাতত এ-কাজে বাধা দিচ্ছে না। তবুও আমাদের এই অপারগতার উৎস কোথায়? দেশের সর্বত্র এ-জাতীয় ব্যর্থতা অত্যন্ত প্রকট। ব্যক্তি-পর্যায়ের গবেষণার সীমাবদ্ধতা এই যে তা খন্ডিত বা বিচ্ছিন্ন হতে পারে। সেই গবেষণার ভিত্তিতে অন্যান্য কর্মী যদি কাজ না করেন, তবে তার সেকেলে রূপ পেয়ে তাৎপর্য হারায়। সার্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে শেষ পর্য ন্ত তার কোনো ফলপ্রদ ভূমিকা থাকে না। আর যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা যৌথ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এক গবেষকের কাছে থেকে অন্য গবেষকের বা গবেষকগোষ্ঠীর কাছে পৌছে গিয়ে জ্ঞান ঐতিহ্যক প্রবহমানতা অর্জন করে, তবে তা সমাজের জন্য সৃষ্টিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রকল্প এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের History of Bengal সিরিজের তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ড আজো প্রকাশিত হয়নি। এই দুটি খন্ড থাকবে যথাক্রমে মুসলমান ও বৃটিশ আমলের সামাজিক, অর্থনেতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ষাটের দশকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের দায়িত্বে বাংলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। আমরা জানিনে, এই প্রকল্পটি কোন অবস্থায় আছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে পরিচালিত এবং বহু পন্ডিতের যৌথ প্রচেষ্টায় বাস্তবায়িত হলে এ ধরনের প্রকল্প আমাদের জ্ঞানকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করতে পারে। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বোক্ত প্রকল্প দুটি ত আমাদের দেশের ইতিহাস ও সাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষণার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এগুলির মূল্য কে অস্বীকার করবে? আমাদের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আ ন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলে এই মূল্যবান প্রকল্প দুটির যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব।

আর্ম-চেয়ার গবেষণার ও বিশেষজ্ঞতার প্রতি খুব সঙ্গত কারণেই অনেকের মধ্যে এক ধরনের অনীহা বা উন্নাসিকতা দেখা যায়। গবেষণালব্ধ জ্ঞান সমাজে আদৌ কাজে লাগবে কিনা, সে ব্যাপারে গবেষক যদি সচেতন থাকেন, তা হলে বোধ হয় এ-সমস্যার খানিকটা সমাধান হবে। সমাজ বলতে আমরা আমাদের আঞ্চলিক সমাজ ও বৃহত্তর মানব-সমাজকে বুঝাতে চাই। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকেও জ্ঞানের বিভিন্ন উপকরণ আমদানী করে বিদ্যমান জ্ঞানের ধারার সঙ্গে তার সমন্বয় সাধন বা স্বাঙ্গীকরণ জরুরী কাজ। এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চললেই তবে আমাদের জ্ঞানের অনুন্নত জগৎ সমৃদ্ধি পাবে। এই গ্রহণধর্মিতার ক্ষেত্রে গোঁড়া স্বাজাত্যাভিমান বা ভাষাকেন্দ্রিক সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি বাঁধা সৃষ্টি করলে তার ফল হবে মারাত্মক।

বিজ্ঞানের ও মানববিদ্যার গবেষণার ফলাফল বা প্রভাব সমাজের নিম্ন স্তরগুলিতেই কমই পৌঁছায়। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সামাজিকীকরণ ও সমাজ কাঠামোর রূপান্তর না ঘটলে এই পরিস্থিতি অপরবর্তিত থাকবে। এই নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে সীমিত গবেষণা-কর্মের সুযোগ আবশ্য আছে। অন্ততঃ ব্যক্তিক প্রয়াসে এবং যতটা সম্ভব যৌথ ভিত্তিতে আমরা অবশ্যই কাজ করব। আল-বেরুনীর এই বিনয়সূচক উক্তি গবেষকের মনে রাখার মতঃ “বিশেষ কোনো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জন্য যা অবশ্যকরণীয়, আমি তাই করছি। পূর্বসুরিদের মৌলিক অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করা, তাতে যে-সব ভুলভ্রাি ন্ত নজরে পড়বে নির্ভীকভাবে তাদের সংশোধন করা এবং নিজের আবিষ্কিয়া সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের লোকজনের জন্য দলিল হিসেবে রেখে যাওয়াই সেই কাজ।” এ-কথা কোনো পান্ডিত্যাভিমানী ব্যক্তির কথা নয়। যিনি সত্যের সন্ধানী যিনি পাÐিত্যের সন্ধানে নিরলস পথচারী এ-কথা তাঁরই কথা। পন্ডিত যিনি, তাঁর সব সম্ভাবনা নিঃশেষিত তিনি ফসিল বা জীবাস্ম। যিনি পান্ডিত্যের সন্ধানী তিনি চলমান জীব-তাঁর সম্ভাবনা অনন্ত। আল-বেরুনীর মতই মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি জ্ঞানের সন্ধানী।